ছন্দ সম্পর্কে না জেনে ছড়া, পদ্য, কবিতা লেখা যাবে না বিষয়টি সে রকম নয়। লেখালেখির জন্য সর্বাগ্রে ইচ্ছেটাই মূল। ভাষা যেমন ব্যাকরণ মেনে তৈরি হয়নি বরং ভাষা তৈরির পরে তাকে সাবলীলতা ও সার্বজনীনতা দান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাকরণ এসেছে; ছড়া, পদ্য ও কবিতার ক্ষেত্রেও তেমনি আগে এগুলি লেখা হয়েছে এবং পরে ছন্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ বিশ্লেষণ করে নানান শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ছন্দবদ্ধ লেখা আগে এসেছে এবং সে ছন্দকে বিশ্লেষণপূর্বক ছড়া, পদ্য ও কবিতা ইত্যাদি নাম করণ করা হয়েছে পরে। প্রকাশের ভঙ্গি ও ছন্দ প্রয়োগের ধরনকে বিশ্লেষণ করেই ছন্দবদ্ধ লেখার শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে এবং নানান নামকরণ করা হয়েছে।
শ্রেণীবিন্যাস হবার পরে সেটিকে বিবেচনায় রেখে যারা তাদের লেখাকে ঐ সংজ্ঞায়িত শ্রেণিতে ফেলার মানদণ্ডে নিতে পেরেছেন তারা কবি বা ছড়াকার নামটির প্রতি সুবিবেচনা করেছেন। যারা সেটা পারেননি তারা সৃষ্টি করেছেন ঠিকই কিন্তু কবি বা ছড়াকার নামটির প্রতি সুবিবেচনা করেননি। শেষোক্তরা সেটা করতে পারেননি বলে তাদের লেখার মান খারাপ হয়েছে সেটিও জোর দিয়ে বলা যাবে না। তবে তারা যদি তাদের সে লেখাকে ছড়া, পদ্য বা কবিতা হিসেবে দাবী করেন তাহলে ভাল বা মন্দ বলার বিষয়টি সামনে চলে আসে। সংজ্ঞায়িত বিষয়ের সাথে না মেলার কারণে সেটিকে তখন খারাপ বলতেই হবে। মেলানোর চেষ্টা না করলে লেখাটি তার অবস্থানে ভাল বা মন্দ হয়ে থাকবে, তাতে কবিতার কিছু যায়-আসে না। লিচুপাতা আর তেজপাতা দেখতে এক রকম বলে একটিকে অপরটি বললে যেমন তা গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি ছন্দবন্ধ লেখাকে কবিতারমত মনে হলেও তা সব সময়ে ছড়া, পদ্য বা কবিতা নয়।
সমগ্র ছন্দ সৃষ্টিকে বিবেচনায় রেখেই যেহেতু এ শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে, সেহেতু এর মধ্যে না পড়লে আসলেও সেটি ভাল কোন লেখা হয় কিনা সেটিও বিবেচনায় রাখা দরকার। লেখাকে প্রচলিত ধারার মধ্যে রাখা যেমন সাধনার বিষয় তেমনি এর বাইরে অন্য কোন ধারা তৈরি করে সে ধারার মধ্যে ফেলাও সহজ বিষয় নয়। একটা কিছু লিখলাম এবং তাকে প্রচলিত ধারার মধ্যে কোন একটা কিছু হয়েছে বলে দাবী করে ফেললাম- যদি তা দাবীকৃত বিষয়ের সংজ্ঞার সাথে না মেলে তবে সে দাবী ঠিক নয়। অন্যদিকে লেখা প্রচলিত ধারার মধ্যে পড়ল না বলে হুট করে সেটাকে একটা ধারা বলে দাবী করে ফেললাম সেটাও সহজ নয়। ধারা নিত্যদিন তৈরি হয় না, হবারমত বিষয় নয়। নতুন ধারা তৈরি করে তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবার জন্যে যে সাধনা ও অধ্যবসায় দরকার তা আমরা করতে পারছি কিনা সেটিও একটি বিবেচ্য বিষয়।
ছন্দ:
কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে। (জীবেন্দ্র সিংহ রায়)
বাংলা কবিতার ছন্দ প্রধানত তিন প্রকার। ১. স্বরবৃত্ত ছন্দ, ২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এবং ৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
যদিও এর বাইরে আরেকটি ছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয় সেটি হল অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এই অমিত্রাক্ষর ছন্দকে বুঝতে হলে অক্ষর সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা দরকার। অক্ষরে অক্ষরে মিত্র হয়ে ছন্দ তৈরি হলে তা মিত্রাক্ষর ছন্দ, অক্ষরে অক্ষরে মিত্র না হয়েও যদি ছন্দ তৈরি হয় তবে তা অমিত্রাক্ষর ছন্দ। সচারচার লেখা কবিতাগুলি মিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা হয়। অমিত্রাক্ষর ছন্দ দিয়ে কবিতা লেখাটা খুবই কঠিন। খুব বেশি কবি কাজটি করতেও পারেন নি। যারা পেরেছেন তাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সবার উপরে।
ছড়া, পদ্য, কবিতা, সায়র ইত্যাদি লিখতে গেলে বর্ণ ও অক্ষর সম্পর্কে জানা থাকলে সুবিধে হয়।
অক্ষর:
বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা একঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বলে। যেমন-
শর্বরী- একটি শব্দ, এখানে তিনটি অক্ষর এবং তিনটি বর্ণ আছে। শর, বো, রী তিনটি অক্ষর এবং শ, ব, র তিনটি বর্ণ।
চিরজীবী- একটি শব্দ, এখানে চারটি অক্ষর এবং চারটি বর্ণ আছে। চি, রো, জী, বী চারটি অক্ষর এবং চ, র, জ, ব চারটি বর্ণ।
কুঞ্জো- একটি শব্দ, এখানে দুইটি অক্ষর এবং দুইটি বর্ণ আছে। কুন, জো দুইটি অক্ষর এবং ক, ঞ্জ (যুক্ত বর্ণ) দুইটি বর্ণ।
বর্ণ:
কোনও লিপি যখন উচ্চারণযুক্ত হয়ে অর্থপূর্ণ ধ্বনি বহন করে এবং ভাষায় ব্যবহৃত হয় তখনই কেবল তা বর্ণ। যেমন- ক, খ, অ, আ।
পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্ব:
পর্ব: কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হল পর্ব।
অতিপর্ব: পঙক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয়। অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে সর্বদাই কম।
উপপর্ব: পর্বাংশ চরণের শুরুতে থাকলে তাকে উপপর্ব বলে।
অতিপর্বের উদাহরণ-
মামার বাড়ি আর যাবো না আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় আমার পিঠে পড়বে না আর অমন তাল।
চরণদুটিকে পর্বে ভাগ করলে দাঁড়ায়-
মামার বাড়ি/ আর যাবো না/ আর খাবো না/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ পড়বে না আর/ আমার পিঠে/ অমন তাল।
৪ মাত্রা + ৪ মাত্রা + ৪ মাত্রা + ৩ মাত্রা = ১৫ মাত্রা।
এখানে প্রতি পঙক্তিতে তিনটি করে পর্ব এবং একটি করে অতিপর্ব মিলে মোট চারটি পর্ব-অতিপর্ব আছে। প্রত্যেক পর্বে সমান সংখ্যক মাত্রা আছে এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অতিপর্ব পর্ব থেকে কম সংখ্যক মাত্রা ধারণ করেছে।
ছন্দ বিন্যাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার, এবং অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা তিন। এই কাব্যাংশে কোনও উপপর্ব নেই।
উপপর্বের উদাহরণ-
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,/
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো/
৩ মাত্রা + ৪ মাত্রা + ৪ মাত্রা = ১১ মাত্রা।
রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় তিন মাত্রার উপপর্ব রেখে চার মাত্রার পর্ব গঠন করেছেন। কবিতাটিতে কোন অতিপর্ব নেই। (ক্রমশ...)
মূল উৎস: কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারী, ২০১১।
কৈফিয়ত: বাংলা একাডেমীর এ লেখাটি বহু ব্লগে হুবুহু প্রকাশিত হয়েছে। এ জন্যে সেগুলিকে উল্লেখ করলাম না। লেখার শুরুতে মূল উৎস উল্লেখ করার দরকার ছিল কিন্তু ভুলে গেছিলাম। যদিও একটা কমেন্টে তা উল্লেখ করেছি তবে সেটি যথেষ্ট নয়। ব্লগার চুপকথা বরাবরেরমত গুতিয়ে আমাকে আবারও বিশুদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।