যাদেরকে উৎসর্গীকৃত: ব্লগার চুপকথা এবং ব্লগার সত্যজিৎ দাশ
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনও একমাত্রা এবং কখনও দুই মাত্রা বহন করে। অর্থাৎ প্রতি পর্বে মাত্রা গণনার রীতি কোথাও স্বরবৃত্তের মতন আবার কোথাও মাত্রাবৃত্তের মতন। বদ্ধস্বর যদি শব্দের প্রথম বা মাঝে থাকে তবে তা এক মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে অবস্থান করলে দুই মাত্রা বহন করে। উদাহরণ স্বরূপ “সূর্যশোক” শব্দটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
স্বর বিন্যাসে শব্দটি নতুন করে লিখে আমরা পাই:
সূর + য + শোক
প্রথম এবং শেষেরটি বদ্ধস্বর, কিন্তু মাঝেরটি মুক্তস্বর। “সূর” বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা এক। অন্যদিকে “শোক” বদ্ধস্বরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা সংখ্যা দুই। আর মুক্ত স্বর “য”-এর মাত্রা সংখ্যা সর্বদাই এক। অতএব অক্ষরবৃত্তের এই নিয়মে “সূর্যশোক” এর মাত্রা সংখ্যা চার।
মাত্রা বিন্যাস: সূর্যশোক> সূর + য + শোক = ১ মাত্রা + ১ মাত্রা + ২ মাত্রা = ৪ মাত্রা
মাত্রা বিন্যাস সহ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কয়েকটি কবিতা।
উদাহরণ ১: পর্বে আট মাত্রা এবং অতিপর্বে ছয়মাত্রা আছে এমন একটি কবিতা:
হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে/ নিশীথের অন্ধকারে/ মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ;/ বিম্বিসার অশোকের/ ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/ আরো দূর অন্ধকারে/ বিদর্ভ নগরে;
(বনলতা সেন/ জীবনানন্দ দাশ)
কাঠামো: ৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ৬ মাত্রা
এখানে “সিংহল” “সমুদ্র” “অন্ধকার” এবং “বিম্বিসার” শব্দ চারটি লক্ষ্য করা যায়। প্রথম শব্দ দু’টি তিনটি করে এবং শেষের শব্দ দু’টি চারটি করে মাত্রা বহন করছে।
এদের স্বর ও মাত্রা বিন্যাস এরূপ:
সিংহল> সিং + হল = ১ মাত্রা + ২ মাত্রা = ৩ মাত্রা
সমুদ্র> স + মুদ + রো = ১ মাত্রা + ১ মাত্রা + ২ মাত্রা = ৪ মাত্রা
অন্ধকার> অন্ + ধো + কার = ১ মাত্রা + ১ মাত্রা + ২ মাত্রা = ৪ মাত্রা
বিম্বিসার> বিম + বি + সার = ১ মাত্রা + ১ মাত্রা + ২ মাত্রা = ৪ মাত্রা
দেখা যাচ্ছে, শব্দের প্রথমে এবং মাঝে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি এক মাত্রা কিন্তু শেষে অবস্থিত বদ্ধস্বরগুলি দু’মাত্রা বহন করছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনার এই রীতি কবি ইচ্ছা করলে বদলে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সব বদ্ধস্বরকে দিতে হবে দু’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা। তবে, সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে পুরো কবিতায় একই নিয়ম প্রতিফলিত হয়। এক কবিতায় দু’রকম নিয়ম অনুসরণ করলে একদিকে পাঠক যেমন বিভ্রান্ত হবেন, অন্যদিকে কবিরও ছন্দে অদক্ষ হাতের প্রমাণ থেকে যাবে।
সকল বদ্ধস্বরকে দু’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এমন একটি কবিতা:
বহুদিন থেকে আমি/ লিখছি কবিতা
বহুদিন থেকে আমি/ লিখিনা কবিতা
(বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা/ সৈয়দ শামসুল হক)
কাঠামো: ৮ মাত্রা + ৬ মাত্রা
এখানে “লিখছি” শব্দটির “লিখ” বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে বসেও দুই মাত্রা বহন করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, এটা কবির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
শব্দের প্রথম ও মাঝের বদ্ধস্বরকে একমাত্রা দেয়া হয়েছে এমন আরো দু’টি কবিতা:
রহে বলী; রাজদণ্ড/ যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা,/ তত তার ক্ষয়।
একা সকলের ঊর্ধ্বে/ মস্তক আপন
যদি না রাখিতে রাজা,/ যদি বহুজন…
(গান্ধারীর আবেদন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাঠামো: ৮ মাত্রা +৬ মাত্রা
হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রীস্টের সম্মান।
কণ্টক-মুকুট শোভা!/ ─দিয়াছ, তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:
(দারিদ্র / কাজী নজরুল ইসলাম)
কাঠামো: ৮ মাত্রা + ৬ মাত্রা
(ক্রমশ…)
মূল উৎস: কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারি, ২০১১।
কৈফিয়ত: বাংলা একাডেমীর এ লেখাটি বহু ব্লগে হুবহু প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র হিসেবে এ জন্যে শুধু মূল উৎসের উল্লেখ করা হয়েছে, ব্লগের সূত্রগুলিকে উল্লেখ করা হয়নি। এটি আমার কোন মৌলিক লেখা নয়। বাংলা একাডেমীর লেখাটি থেকে সঙ্কলিত করে সহজতর করার চেষ্টা করেছি মাত্র।