ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক উপন্যাস: মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয় নাই (প্রথম খণ্ড—প্রথম পর্ব)



















মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক উপন্যাস:

মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয় নাই
(প্রথম খণ্ড—প্রথম পর্ব)
সাইয়িদ রফিকুল হক
 

 
অধ্যাপক লিটু মিয়া মনে করেন: ২০০৮ সালের ২৯-এ ডিসেম্বর এই বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতালাভ করেছে। এই তো মাত্র কয়েক বছর আগেও এই দেশে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীর মতো—সাধারণ নিরীহ মানুষ থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগারদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে একাত্তরের সেই পরাজিতশক্তি—রাজাকারদের সমন্বয়ে সংগঠিত চারদলীয় বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী-সরকারের সন্ত্রাসী-ক্যাডাররা। দেশের ভিতরে তখন সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের তথা সমগ্র বাঙালি-জাতির মনের মধ্যে কী-এক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিলো। একাত্তর-সালের মতো এইসব রাজাকার-অপশক্তি কুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-চেতনায় বিশ্বাসী সর্বস্তরের মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বী রাজনৈতিক শক্তি: বাংলাদেশআওয়ামীলীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীদের নিধন করার প্রক্রিয়া শুরু করার মধ্য দিয়ে—তারা দেশটাকে একাত্তরের মধ্যযুগীয় পাকিস্তানী-শয়তানীধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আবার পাকিস্তান-কায়েমের চেষ্টা চালিয়েছিলো। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আর এই দেশের সাহসী জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেদিন ঐতিহাসিক ব্যালট-বিপ্লবের মাধ্যমে দেশটা আবার মাথা-উঁচু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
 
দেশের কথা ভাবতে-ভাবতে লিটু মিয়া একসময় উঠে দাঁড়ালেন। আর ভাবলেন: এই দেশটাতে আর কোনোদিন একাত্তরের পরাজিত-অপশক্তির দুঃশাসন মেনে নেওয়া যাবে না। বিগত বছরগুলোতে যা হওয়ার তা-তো হয়েই গেছে—কিন্তু আর যেন এমনটি না হয়। কারণ, যেকোনো ভুল মানুষের জীবনে একবারই হওয়া উচিত—এর বেশি হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তাই, আজ-এক্ষুনি, এইমুহূর্ত থেকে, সারাজীবনের মতো বাংলাদেশের সকল ছোট-বড় রাজাকার, রাজাকারশক্তি ও রাজাকারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সবদিক দিয়ে আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। তার কারণ, সেইসব পাপিষ্ঠ-পামর এখনও আবার অবৈধ উপায়ে আমাদের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা-দখল করার ঘৃণ্যপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদের শয়তানী কখনও থামবে না। এরা এদের সেই পুরাতন গালভরা ধর্মীয় বুলির সাহায্যে এ-দেশের সাধারণ মেহনতী মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কথিত শয়তানী-নির্বাচনের নামে আবার আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতাদখল করতে চায়। এদের সেই পাঁয়তারা এখনও সমানভাবে অব্যাহত রয়েছে। এরা প্রতিদিন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আর প্রতিদিন একইভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এরা ষড়যন্ত্র করতে ভালোবাসে—আর এরা সবসময় শয়তানী-ষড়যন্ত্র করতে জানে। তাই, বর্তমানে দেশে শুরু হওয়া একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে এরা রাতদিন, সমানে, একের-পর-এক শয়তানী ও আবোলতাবোল বক্তব্য প্রদান করছে, এবং একের-পর-এক যারপরনাই শয়তানী-দুষ্কর্ম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এরা বাংলাদেশের তথাকথিত ও পাকিস্তানপন্থী জাতীয়তাবাদীদল। আসলে, এরা ইসলামবিরোধী এজিদবংশীয় পাকিস্তানবাদী ওহাবী-খারিজী-মওদুদীবাদী একদলীয়-একজাতীয়-একইসূত্রমতে ইসলামী-ত্বরীকাবিরোধী ভণ্ড—এক বাতিলশক্তি। এরা সেই একাত্তর-সালের মতো মুখে ইসলাম-ইসলাম করে আবার এই দেশটার চূড়ান্ত সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। কিন্তু সেই সুযোগ তারা আর পাবে না। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে।
এসব ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। আর তিনি ঘড়ি দেখে বুঝলেন, এবার তার বাইরে বের হওয়ার সময় হয়েছে।
 
অধ্যাপক লিটু মিয়া খুব তাড়াহুড়া করে বাইরে বের হচ্ছিলেন। এমনিতে তিনি প্রয়োজন ছাড়া আজকাল খুব একটা বাইরে বের হন না। আজ তিনি একান্ত-ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা-পোষণ করেছেন। তবে বাইরে তার গুরুতর কোনো প্রয়োজন নেই। বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন আড্ডা দেওয়া হয় না। তাই, তিনি আজকে একটু বেশি সময় আড্ডা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
 
দেশপ্রেমিক বন্ধুদের সঙ্গে তার আড্ডা দিতে খুব ভালো লাগে। আর মাঝে-মাঝে এভাবে একটু আড্ডা না দিলে এই জীবনের যেন মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বাইরে বের হবেন—এমন সময় তার বাসার দরজার কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
 
কিছুদিন হলো তার বাসার কলিং-বেলটা ঠিকভাবে কাজ করছে না। তাই, কোনো লোকজন এলে দরজার কড়া নাড়ে। তিনি দরজা খুলে খুব অবাক হলেন। আর দেখলেন, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার প্রধান শিষ্য: অধ্যাপক আবু কায়েস। আর তার সঙ্গে রয়েছে আরও দু’জন অপরিচিত তরুণ।
তাদের দেখে লিটু মিয়া কিছুটা অবাক হলেন। আর তাদের হঠাৎ এই আগমনের কারণ তিনি অনুধাবন করতে পারলেন না। এমন মুহূর্তে লিটু মিয়া কী বলবেন তা তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাদের আগমনের কারণ তিনি ভাবতে লাগলেন।
তাই, লিটু মিয়া কিছু বলার আগেই অধ্যাপক আবু কায়েস তার গুরুকে সালাম দিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে পড়লো।
লিটু মিয়া এতোক্ষণে বুঝলেন আজ তার আর আড্ডা দেওয়া হবে না।
ওরা বাসার ভিতরে প্রবেশ করার পরও লিটু মিয়া কিছু-একটা ভাবতে-ভাবতে আরও কিছুক্ষণ যেন সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন।
 
অধ্যাপক লিটু মিয়া কিছু বলার আগেই আবু কায়েস তার সঙ্গে আগত দুই আগন্তুককে দেখায়ে একটু হেসে বলতে শুরু করলো: “স্যার, এরা দু-জন আমার আপন-মামাতো ভাই। এই শহরেই থাকে। আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৯৭১ সালে সংঘটিত পবিত্র-মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে এদের জন্ম। আমাদের মতো এরাও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তাই, এরা আপনার কাছে আজ এসেছে, পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস-সত্যঘটনা-সত্যকাহিনী শুনতে। তার আগে আপনাকে একটু কষ্ট করে এই বাংলার পাকিস্তানী-আমলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও সংক্ষেপে তুলে ধরতে হবে। আর তৎসঙ্গে ১৯৭১ সালে, শয়তান পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীসহ এদেশীয় কুলাঙ্গার রাজাকারগোষ্ঠী তথা পাপিষ্ঠ-যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মের বিবরণও কিছুটা তুলে ধরবেন। এসব এদের জানা দরকার। সামনে আসছে পবিত্র ১৬ই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে আপনার মুখ থেকে নিঃসৃত সত্যকথা শ্রবণপূর্বক এদের দেশপ্রেম আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে, ইনশা আল্লাহ। তাই, আপনার মুখ থেকে এই বাংলার আদি-আসল ইতিহাস শুনে এরাও হতে পারে কোনো দেশদরদী-সূর্যসন্তান, আর নবপ্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।”
 
অধ্যাপক লিটু মিয়া এবার ধীরেসুস্থে মুখ খুললেন। আর তিনি কিছুটা ব্যথিতভাবে কিন্তু খুব সন্তুষ্টচিত্তে বলতে লাগলেন:
“আজ আমার খুব ভালো লাগছে যে, দু-জন যুবক তার পূর্বপুরুষের আদি-আসল ইতিহাস―আসল জন্মবৃত্তান্ত শুনতে এসেছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই জাতির জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান ও পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে সবার আগে তোমাদের জানতে হবে: ১৯৪৭ সালের ধোঁকাবাজির ও শয়তানীর পাকিস্তান-কায়েমের কথা। আর শয়তানীপাকিস্তান থেকে কীভাবে ১৯৭১ সালে আমাদের ‘পবিত্র বাংলাদেশ’ সংগঠিত হলো তার কথা। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, আজকের এই স্বাধীন-সার্বভৌম-পবিত্র বাংলাদেশের তথা বাঙালি-জাতির উত্থানের পিছনে রয়েছে ২৩ বছরের রাজনীতি-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। আর এর অগ্রভাগে-পুরোভাগে-নেতৃত্বে-পুরোধাপুরুষরূপে ছিলেন: আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম-পবিত্র বাংলাদেশরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি-জাতি ও বাঙালি-মুসলমানের ইমাম, আমাদের জাতির জনক: হজরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রহমাতুল্লাহ আলাইহি। তাঁরই নেতৃত্বে ঊনিশ’শ একাত্তর সালে, একটা শয়তানবংশীয় তথা এজিদবংশীয় শয়তানী পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনী নামক নরপশুদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ নামক পবিত্র লড়াইসংগ্রাম করে আমরা এই দেশটাকে স্বাধীন করেছি। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করেছেন—এই মাটির শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র সন্তান—পবিত্র আত্মার অধিকারী সৎ-সাহসী ও বীরকুলশিরোমণি মুক্তিযোদ্ধাগণ। আজ তোমরা আমার কাছে এসেছো সেই পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের কথা তথা পবিত্র ইতিহাস শুনতে। আমি তোমাদের কাছে খুব সংক্ষেপে সেই পবিত্র কাহিনী তুলে ধরবো। তার আগে আমি তোমাদের পরিচয় একটু জানতে চাচ্ছি—যদি তোমাদের এইব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি না থাকে।”
 
তার কথা শুনে আবু কায়েসের ডানপাশে বসা যুবকটি সঙ্গে-সঙ্গে এক-টুকরা সরল হাসিতে বিনয়ের সঙ্গে বললো: “না-না, আপত্তি কীসের। এতো খুব ভালো কথা। আমার নাম আবীর হাসান। আমি মোহাম্মদপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি—আর্টস গ্রুপে।”
বামপাশের যুবকটি বললো: “আর আমি মাকিদ ইব্রাহিম। ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। আমি আর আবীর সম্পর্কে মামাতো-ফুফাতো ভাই। আর আমরা একই এলাকায় থাকি।”
 
অধ্যাপক লিটু মিয়া এবার স্মিতহাস্যে বললেন: “আপাততঃ এতেই চলবে। পরে তোমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়লে তখন তোমাদের সম্পর্কে আরও বেশি জেনে নেব। আজ এ-পর্যন্তই থাক। আজ তোমরা এই বাংলার স্বাধীনতাপূর্ব আদি-আসল ইতিহাস জেনে নাও। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এই বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি কী ছিলো, তা আমি তোমাদের কাছে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরছি। এরপর আমরা মূল আলোচনায় প্রবেশ করবো। তবে এব্যাপারে আমার একটি শর্ত: এসব আলোচনা কিন্তু তোমাদের খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। আর আলোচনার সময়—আলোচনার মাঝখানে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তোমরা, যে-কোনো প্রশ্ন করবে একটি বিষয়ে আলোচনার শেষে। তাছাড়া, আলোচনার একদম শেষে হাজারখানেক প্রশ্ন করতেও তোমাদের কারও কোনো বাধা নাই।”
শেষের কথাটা বলে তিনি ওদের দিকে চেয়ে একটুখানি হাসলেন।
তার কথা শুনে উপবিষ্ট সকলেই মুগ্ধভাবে হাসলো।
অধ্যাপক লিটু মিয়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। তার গবেষণা চলছে, আর এটি আমৃত্যু চলবে। আর তিনি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি বাংলার সর্বকালের সর্বকুখ্যাত পাপিষ্ঠ-রাজাকারদের বংশপরিচয়ও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি মনে করেন: এই বাংলার সর্বস্তরের রাজাকাররা বাংলাদেশবিরোধী একদলীয়-একজাতীয়-একবংশীয় ঘাতকসম্প্রদায়। স্বার্থের জন্য এরা সেই ১৯৭১ সাল থেকে ভিন্ন-ভিন্ন নামে পরিচিত হতে পারে। কিন্তু এদের স্বভাবচরিত্র, অপআদর্শ, কর্মপদ্ধতি ও বংশগতি একইসূত্রে বিকশিত হয়েছে। আর এদের সবাই মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক-নরপশুগোষ্ঠী।
 
আপনমনে ইতিহাসের সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে অধ্যাপক লিটু মিয়া তার ঐতিহাসিক বক্তব্য শুরু করার প্রস্তুতিগ্রহণ করতে লাগলেন।
তিনি কথা শুরু করবেন, এমন সময় তার বাসায় উপস্থিত হলো অধ্যাপক রায়হান কবির। তার সঙ্গেও রয়েছে দু-জন অপরিচিত যুবক। তাদের দেখে লিটু মিয়া আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এরা হয়তো রায়হানের দুঃসম্পর্কীয় কোনো মামাতো-ফুফাতো কিংবা চাচাতো কিংবা ফুফাতো ধরনের ছোট ভাইটাই হবে। তাই, তিনি ভাবলেন: পরে এদের পরিচয় জানা যাবে। এখন কথা শুরু করাই ভালো। এমনিতে আলোচনার জন্য অনেক সময় লাগবে। তিনি এসব ভাবতে-ভাবতে কথা শুরু করবেন, এমন সময় তাকে কিছুটা বিলম্ব করতে অনুরোধ করলো রায়হান কবির। সে বিনয়ের সঙ্গে বললো: “গুরুজী, এদের পরিচয়টা আপনি বক্তৃতা দেওয়ার আগে যদি একটু শুনতেন—তাহলে, আমরা বড়ই কৃতার্থ হতাম।”
 
অধ্যাপক লিটু মিয়া এবার হেসে ফেললেন। আর বললেন, “তাহলে, ওদের পরিচয় বলো, শুনি।”
 
রায়হান কবির এবার হাসিমুখে বললো, “আমার ডানপাশে যে-বসেছে, সে আমার প্রতিবেশী ছোট ভাই। ওর নাম আদিব হোসেন সৌরভ। এবার অনার্স ফার্স্ট-ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। ওর সাবজেক্ট ইতিহাস। আর যে বামপাশে বসেছে, সেও আমার এক প্রতিবেশিনী খালার ছেলে—মানে, সে আমার একরকম খালাতো ভাই হয়। আর সেও অনার্স ফার্স্ট-ইয়ারে পড়ে। ওর নাম কায়সার সাফিন বিপ্লব। আর ওর সাবজেক্ট বায়োলজী।”
পরিচয়-পর্ব শেষে সৌরভ আর বিপ্লব উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে অধ্যাপক লিটু মিয়াকে সালাম জানালো। আর লিটু মিয়া স্মিতহাস্যে সালামের জবাব দিয়ে তাদের বসতে বললেন।
একটু পরে লিটু মিয়া ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে তা এখনই করতে পারো। একবারে সবার প্রশ্ন শুনতে পারলে আমি সহজে সবার উত্তর দিতে পারবো।”
 
ওরা দু-জন নবাগত। তাই, একটুখানি জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। আর একটুখানি  কাঁচুমাচু করতে লাগলো। ঠিক কী বলবে—তা যেন ওরা ভেবেচিন্তে ঠিক করতে পারছিলো না। শেষে সৌরভই উঠে দাঁড়ালো আর বললো: “স্যার, আমরা দু-জন রায়হান-স্যারের সঙ্গে এসেছি, আপনার নিকট থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে। আপনি, আপনার কলেজের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত পাঠদানের মতো করে আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করলে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আর সেইসঙ্গে ১৯৭১ সালের কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের দোসরদের অপতৎপরতা সম্পর্কেও বিস্তারিত বলবেন।”
অধ্যাপক রায়হান বললো, “স্যার, আপনি একনাগাড়ে সব বলে যান। আর সবকিছু বলা শেষ না হলে আপনি সহজে থামবেন না। আমরা আজ একনিঃশ্বাসে সবকিছু শুনতে ও জানতে চাই।”
 
অধ্যাপক লিটু মিয়া হেসে বললেন, “আচ্ছা, তা-ই হবে। তোমাদের সবার মনের আশা যাতে পূর্ণ হয়—আমি সেভাবেই সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরছি। তজ্জন্য তোমরা এখন থেকেই নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত মনোযোগবৃদ্ধি করো। আর একটা কথা: আমার বক্তব্য শুরু হলে তোমরা কেউ আর-কোনো কথা বলতে পারবে না। তবে আমি নিজে থেকে প্রয়োজনে মাঝে-মাঝে থামবো। আর নতুন কোনো অধ্যায় শুরু করার আগে তার নামও বলে দেবো—যাতে তোমরা সবকিছু অধ্যায়ভিত্তিক বুঝতে পারো। আর-একটা কথা: আমি যদি তোমাদের কোনো কথা বলার সুযোগ দেই—তাহলে, তোমরা তখন শুধু বলতে পারবে।”
আগন্তুক শ্রোতৃমণ্ডলী তার কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
এমন একটা সময় অধ্যাপক লিটু মিয়া বলতে শুরু করলেন:
 
“মনে পড়ে তোমাদের, সেই ১৯৭১ সালের কথা? এই দেশের পবিত্র স্বাধীনতার জন্য পবিত্র মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন ত্রিশ লক্ষ মানুষ। আর বাংলার এই স্বাধীনতাসংগ্রামের রয়েছে তেইশ বছরের জাজ্বল্যমান লড়াইসংগ্রামের ইতিহাস। এই পৃথিবীর বুকে পাকিস্তান নামক একটি শয়তানরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাঙালিরা তেইশ বছর যাবৎ লড়াইসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশটাকে স্বাধীন করেছেন। আর তখন, বাংলাদেশরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ-এককাট্টা হয়েছিলো পৃথিবীর সমস্ত অভিশপ্ত শয়তান—শয়তানরাষ্ট্র—শয়তানবংশ—আর সর্বস্তরের শয়তানচক্র—আর শয়তানগোষ্ঠী—আর শয়তানবাহিনী। তা সত্ত্বেও, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতালাভের পর বিশ্বের বুকে সগৌরবে মাথা-উঁচু করে দাঁড়িয়েছে আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম-পবিত্র বাংলাদেশ। আজ আমি তোমাদের সেই সত্যঘটনা-সত্যকাহিনী শোনাবো। আর তোমরা এইসব ঘটনার প্রতিটি কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কারণ, এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আলোকেই ১৯৭১ সালে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি-জাতির আত্মপরিচয়ের এক বিশালবিরাট মহাকাব্য রচিত হয়। আর এই মহাকাব্যই বাঙালি-জাতির আদি-আসল-প্রকৃত ইতিহাস। বাঙালি-জাতির জীবনে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধই প্রকৃত ও সম্পূর্ণ ইতিহাস। এটি এখনও জাতির জীবনে পবিত্রতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর জাতির জীবনে এর চেয়ে বড় কিছু নাই।
 
বেশিদিন আগের কথা নয়—১৯৭১ সাল!
মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের কথা?
পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় রক্তাক্ত-কারবালা।
 
যুদ্ধ চলছিলো। মহান যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ। জনযুদ্ধ। আর আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। আর আমাদের বাঁচা-মরার যুদ্ধ। তাই, আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনী নামক একটি পরিকল্পিত শয়তানগোষ্ঠী তথা এজিদবংশের লোকদের বিরুদ্ধে।
একদিকে ছিলেন মহান আল্লাহর মনোনীত পবিত্র ইসলামধর্মের একমাত্র পথপ্রদর্শক: হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী—আর তাদের নেতা—বাঙালি-জাতি ও বাঙালি-মুসলমানের ইমাম: হজরত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রহ. ও তাঁর নেতৃত্বাধীন বাঙালি-জাতির মুক্তির নেতৃত্বদাতা-মুক্তির পথপ্রদর্শক বাংলাদেশআওয়ামীলীগ তথা আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব। আর দল-মত-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সর্বস্তরের জনগণ, স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বী, স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বী সকল রাজনৈতিক দল। অপরদিকে ছিলো: শয়তানের দোসর এজিদের বংশ—পাকিস্তানী-হায়েনাদের হানাদারবাহিনী। আর তাদের সাহায্যকারী-সহযোগী যাবতীয় শয়তানীবাহিনী—এই এজিদবংশের সঠিক উত্তরাধিকারী বাংলাদেশের এজিদবংশ: জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও তাদের সাহায্যকারী-সহযোগী অন্যান্য সংগঠন: ইসলামী-ছাত্রসংঘ (আজকের ইসলামী-ছাত্রশিবির), কথিত শান্তিকমিটি (ইংরেজিতে ‘পীস-কমিটি’), রাজাকারবাহিনী, আলবদরবাহিনী, আলশামসবাহিনী, পূর্বপাকিস্তান মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পশ্চিমপাকিস্তান মুসলিমলীগ, পিরোজপুরের নেছারাবাদের শর্ষিণাছারছীনা আলিয়ামাদ্রাসা ও এই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আবু জাফর ছালেহ-এর নেতৃত্বাধীন গুপ্তঘাতকবাহিনী, চট্টগ্রামের দারুল উলুম হাটহাজারীমাদ্রাসা ও তাদের নেতা সিদ্দিক আহমেদ ও শাহ আহমেদ শফীর নেতৃত্বাধীন পাকবাহিনীর সহযোগী ‘মুজাহিদবাহিনী’ (এদের বর্তমান উত্তরাধিকারী হচ্ছে—আজকের কথিত ‘হেফাজতে ইসলাম’ ওরফে ‘হেফাজতে শয়তান’ পাকিস্তান। আর বর্তমানে ২০১০ সালে নবগঠিত ও কথিত ‘হেফাজতে ইসলাম’ আসলে একাত্তরের পাকবাহিনীর নারকীয় অপকর্মের অন্যতম সহযোগী-সংগঠন চট্টগ্রামের ‘মুজাহিদবাহিনী’র নব্যসংস্করণ), ন্যাপ-ভাসানী, চীনপন্থী বিভিন্ন গুপ্তঘাতক-পার্টি ইত্যাদি। সারাপৃথিবীতে ষড়যন্ত্রকারী এজিদবংশের লোকেরা এখনও এক—আর আজও এইসব শয়তানের সেইসব শয়তানী বহাল রয়েছে। তাই, এরা এক হয়েছিলো ১৯৭১ সালে, আমাদের প্রাণপ্রিয় রাষ্ট্র: বাংলাদেশটাকে ধ্বংস করতে। কিন্তু পারেনি। কারবালার ময়দানে, ফোরাতনদীর তীরে, সেদিন আপাতদৃষ্টিতে এজিদবাহিনী কূটকৌশলে ইমাম হোসেন-বাহিনীকে পরাজিত করেছিলো। কিন্তু এখানে, মানে, ১৯৭১ সালে—বাংলাদেশে, এজিদবাহিনী পরাজিত হয়েছিলো ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যসহ। ওরা আমাদের কাছে মাথানত করে মাফ চেয়েছে—আর ঘাড়হেঁট করে বলেছে: আমরা তোমাদের সঙ্গে আর যুদ্ধ করবো না। আমাদের এবার মাফ করে দাও, মাফ করে দাও, আর মাফ করে দাও।... বাঙালি মানুষ বলেই সেদিন ‘জেনেভা-কনভেনশন-রুল’ মেনে পৃথিবীর সর্বকালের কুখ্যাত পাকিস্তানীনরপশুদের ক্ষমা করে দিয়েছে।
 
১৯৭১ সালে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ-কাহিনীর নাম: ‘রক্তাক্ত দ্বিতীয় কারবালা’। আর আমাদের এই পবিত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন: হজরত ইমাম হোসেন-বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী: বাঙালি-জাতি ও বাঙালি-মুসলমানের ইমাম-নেতা: হজরত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর নেতৃত্বাধীন আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম-পবিত্র বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় জন্ম নেওয়া বাংলাদেশআওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বাপেক্ষা দুর্ধর্ষবাহিনী—‘মুক্তিবাহিনী’। আর এই মুক্তিবাহিনীর নাম শুনে রাজাকারবাহিনী ও পাকবাহিনীর লোকদের প্যান্ট ভিজে যেতো—এককথায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে প্রস্রাব করে ফেলতো। এই সুবিশাল মুক্তিবাহিনীর অধীনে লক্ষ-লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ‘জয়-বাংলা’ ও ‘জয়-বঙ্গবন্ধু’ নামক দুটি পবিত্র শ্লোগানকে হৃদয়ে ধারণপূর্বক পবিত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে—পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনী নামক কুখ্যাত শয়তানবাহিনীর বিরুদ্ধে।
বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা ইমাম হোসেন-বংশের সঠিক উত্তরাধিকারী। তাঁরা এজিদবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে-ঠেকাতে গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে সারাপৃথিবী কাঁপিয়ে বাংলাদেশটাকে স্বাধীন করে ফেললো। এটি শুনলে তোমাদের কাছে এখন গল্পের মতো মনে হবে। কিন্তু এটিই বাস্তব ইতিহাস—এটিই আসল সত্য।
তার আগে সেই ১৯৪৭ সাল!
পাকিস্তান নামক একটি মৌলবাদী-রাষ্ট্রের জন্ম হলো। কিন্তু তখন কেউ বুঝতে পারেনি—পাকিস্তানী-নেতাদের এই উঁচুদরের শয়তানী। তখন সমগ্র পাকিস্তানে শয়তানের সুপ্রীম-কমান্ডার ছিল: শয়তানপুত্র মোহাম্মদ আলী জিন্না। সে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশরাষ্ট্র ও পবিত্র বাংলাভাষার চিরশত্রু। তাদের শয়তানী-চক্রান্তে আমাদের বাঙালি-নেতৃত্ব সেদিন পরাজিত হয়েছিলো। আর পাকিস্তানীরা আমাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানরাষ্ট্র কায়েম করে আমাদের চিরতরে গোলাম বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। অথচ, পাকিস্তানরাষ্ট্র কায়েমের সময় তারা বলেছিলো: ‘বাংলাদেশ তথা পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিমপাকিস্তান-এর লোকজন ভাই-ভাই হয়ে থাকবে।’ ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ভারত থেকে পৃথক হয়ে যায়—আর গঠিত হয় স্বাধীন পাকিস্তানরাষ্ট্র। আর আমরা সেদিন পাকিস্তানের সঙ্গে থাকায় আমরাও পাকিস্তানের সঙ্গে তথাকথিত স্বাধীনতা—নামকাওয়াস্তে স্বাধীনতালাভ করি। আর আমাদের সরকারি নাম রাখা হয়: পূর্বপাকিস্তান। প্রকারন্তরে আমরা হয়ে যাই পাকিস্তানের করদরাজ্য—গোলামরাজ্য। ‘ভাই-ভাই’ বলে আর ‘মিলেমিশে’ থাকার কথা বলে পাকিস্তানীরা আমাদের সম্পূর্ণ ধোঁকা দিয়েছিলো। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানীরা আমাদের সঙ্গে একদিনের জন্যও ‘না মুসলমানের—আর না মানুষের’ মতো ব্যবহার করেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী শয়তানী-শাসকবর্গ আমাদের প্রতিদিন নিত্যনতুনভাবে ঠকিয়েছে আর নিত্যনতুনভাবে প্রতারণাও করেছে। পাকিস্তানী-শাসকরা ছিল শয়তানের প্রেতাত্মা। মূলত পাকিস্তানরাষ্ট্রের জন্ম হয় সম্পূর্ণ ধোঁকাবাজির মাধ্যমে। সেদিন জিন্নার মতো প্রথম শ্রেণীর ধোঁকাবাজ ও শয়তানচক্র এক হয়েছিলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ধ্বংস করার জন্য। তাই, ১৯৪৭ সালে আমাদের রাষ্ট্রের নামকরণে ‘বাংলাদেশ’ পবিত্র নামের পরিবর্তে আমাদের গায়ে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয় শূয়রের তকমা পূর্বপাকিস্তান। আর সেদিন থেকেই পাকিস্তানীরা আমাদের বিরুদ্ধে সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত শুরু করে। আর দুই-রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ-সহাবস্থানের নামে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে মিসকিন-প্রদেশে পরিণত করে। কিন্তু সব চক্রান্তের শেষ আছে। আর চক্রান্তকারীরা চিরদিন চক্রান্ত করে থাকে। তবুও তারা পৃথিবীতে টিকতে পারে না। আর চিরদিন চক্রান্তকারীরা বিজয়ী হয় না। কষ্টে হলেও মজলুমের ভাগ্যে একদিন শিঁকে ছেঁড়ে।
আমাদের উপর প্রথম আঘাত—পবিত্র বাংলাভাষা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী শয়তানী-শাসকবর্গের নজিরবিহীন শয়তানী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত:
বাংলাভাষার জন্ম আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। আর একহাজার বছর আগে এই পবিত্র ভাষার রচিত আদি নিদর্শন-সাহিত্যসামগ্রীর সন্ধান মেলে। তারও পূর্বে হয়তো বাংলা-সাহিত্য রচিত হয়। কিন্তু তার সন্ধান মেলেনি। ১৯০৭ সালে, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয় নেপালের রাজদরবার থেকে এটি উদ্ধার করেন। পরে ‘হাজার বছরের পুরানো বৌদ্ধগান ও দোঁহা’ নামে এটি প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। যে-ভাষার জন্ম আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, আর যে-ভাষার আদি নিদর্শন মিলেছে একহাজার বছর আগেকার—আর সেই ভাষা বুঝি তার জাতির কাছে অচল হবে! আর তৎপরিবর্তে চালু হবে বিজাতীয় জোড়া-তালি দেওয়া ‘খিচুরিভাষা’ কিংবা ‘বিজাতীয় ভাষা’ উর্দু? এই উর্দুভাষা তৎকালে সমগ্র পাকিস্তানেও কোনো একনাম্বার ভাষা ছিল না। উর্দু ছিল দুইনাম্বার ভাষা! সেই সময় দুই পাকিস্তান মিলিয়ে মানুষ উর্দুতে কথা বলতো শতকরা মাত্র ১৭জন, এবং শুধু পশ্চিমপাকিস্তানে উর্দুভাষা ব্যবহার করতো মাত্র ১৪ভাগ মানুষ। আর সেই সময় দুই পাকিস্তান মিলিয়ে বাংলাভাষায় কথা বলতো শতকরা ৫৬জন মানুষ, এবং পূর্বপাকিস্তান নামক বাংলাদেশে বাংলাভাষায় কথা বলতো শতকরা ১০০জন মানুষ। পশ্চিমপাকিস্তানেও উর্দুর চেয়ে এগিয়ে ছিল পশতু, সিন্ধি, বেলুচ ইত্যাদি। সেখানেও তারা গায়ের জোরে উর্দুকে রাষ্টভাষা করে আবার তার দুর্গন্ধ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে দেওয়ার জঘন্য শয়তানী করেছিলো সেদিনের পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকবর্গ। কিন্তু তাদের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সেদিন মেনে নেয়নি বাঙালি-জাতি। তাই, মানবতার ইতিহাসে যুক্তির জোরে দুনিয়ার কোথাও টিকতে না পেরে পাকিস্তানী-নরপশুরা ১৯৪৭ সাল থেকে বাঙালি-জাতির বিরুদ্ধে বিজাতীয়ভাবে ফুঁসে ওঠে।
পশ্চিমপাকিস্তানের নরপশু-সামরিকজান্তাদের পক্ষে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে প্রথম শয়তানী-ষড়যন্ত্রের ঘোষণা দেয়: ১৯৪৭ সালের ১৮ই মে নিখিল-ভারত মুসলিমলীগের নেতা নামক এক পাপিষ্ঠ, কমজাত ও শয়তানের জারজপুত্র চৌধুরী খালেকুজ্জামান। সে হায়দ্রাবাদের এক জনসভায় বাঙালি-জাতির সঙ্গে এক চরম বেআদবি করে বলে ফেললো: ভবিষ্যৎ-পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা’ হবে উর্দু। এরপর ১৯৪৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষাসম্মেলনে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ পেশ করে সেদিনের পাকিস্তানের সর্বস্তরের দালাল ও পা-চাটা কুকুরগুলো। আর এতে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ—রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামরত বাংলার নেতৃবৃন্দ—আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এইসময় পাকিস্তানীদের সমস্ত চক্রান্ত তথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শয়তানীচক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি-জাতি একসময় গড়ে তোলে ‘রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রামপরিষদ’। মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে দাবি-আদায়ে এইসময় ‘তমুদ্দুন মজলিশ’ নামক একটি সংগঠনও কিছুটা ভূমিকাপালন করে। ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলাভাষার পক্ষে বাংলাভাষাপ্রেমী দল-মত-শ্রেণী-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে বাঙালি-জাতির মধ্যে এক সুবিশাল ঐক্য গড়ে ওঠে। বাংলাভাষাকে রক্ষা করতে এবং বাঙালি-জাতির চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে এইসময় বঙ্গবন্ধু এককভাবে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক পরিচয়ে সম্পূর্ণ বাংলাদেশী-ভাবধারায় বাংলাদেশের পক্ষে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুআরি আদর্শবাদী ছাত্রসংগঠন—‘ছাত্রলীগ’প্রতিষ্ঠা করলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ২৩-এ জুন এই ‘ছাত্রলীগে’র পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আওয়ামী-মুসলিমলীগ’। এরপর ১৯৫৬ সালে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সকল বাঙালি জনমানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়: আওয়ামীলীগ—আজকের বাংলাদেশআওয়ামীলীগ।
 
১৯৪৮ সালের ১৯-এ মার্চ পাকিস্তানের তথাকথিত গভর্নর জেনারেল নামক কালশয়তান ও শয়তানের জারজপুত্র: মোহাম্মদ আলী জিন্না ঢাকায় আসে। সে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন-হলে অনুষ্ঠিত এক-সভায় সরাসরি ঘোষণা করে: ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সেদিন, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা জিন্নার মুখে সরাসরি জুতা-নিক্ষেপ করেছিলো। আর এই বেআদবের ঘোষণা শেষ হতে-না-হতেই ১৯৪৮ সালের ২৩-এ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও শয়তানের আরেক জারজপুত্র: খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের সংসদে ঘোষণা দিলো: ‘উর্দুই হবে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের ভাষা’। ভণ্ডশয়তান নাজিমউদ্দিনদের এই শয়তানীঘোষণা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলেন না আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তখন থেকেই আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আমাদের বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় অ্যাকশন-কাউন্সিল’। এতে ছাত্র-জনতাসহ সকল শ্রেণীর মানুষ যোগদান করলো। পাকিস্তানীদের এই শয়তানীর বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ হরতালের ডাক দিলেন বাঙালির তরুণ-নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেইদিন হরতাল চলাকালীন সময় ঢাকার সচিবালয়ের সম্মুখে আন্দোলনরত অবস্থায় গ্রেফতার হলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই থেকে শুরু হলো তাঁর একের-পর-এক গ্রেফতারের ও কারাবরণের পালা। এই বাঙালি-জাতির মুক্তির জন্য এভাবে তিনি ১৪বছর জেল খেটেছেন। ১৯৪৯ সালে, কিছুদিনের জন্য তিনি পাকিস্তানীদের জেল থেকে মুক্তি পেলেও ১৯৫০ সালে আবার গ্রেফতার হলেন। ১৯৫২ সালের ২৬-এ জানুআরি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শয়তানের জারজপুত্র: খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এসে বেআদব জিন্নার মতো সেও আবার ঘোষণা করে: ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এবার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলার সমগ্র ছাত্র-জনতা। তারা একসঙ্গে রুখে দাঁড়ায়। আর মনে মনে শপথগ্রহণ করে এই জালেম-শয়তানদের আর কোনো শয়তানী মানা যাবে না। নাজিমউদ্দিনদের এই শয়তানীর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩০-এ জানুআরি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হলো। আর আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য সর্বদলীয় ‘রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রামপরিষদে’র আহ্বানে ১৯৫২ সালের ৪ঠা ফেব্রুআরি সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। জেলখানায় বন্দিদশা থেকেই বঙ্গবন্ধু ‘অ্যাকশন-কাউন্সিল’কে ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুআরি বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবিতে সবাইকে আন্দোলন করতে নির্দেশ দিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে এবার আরও ফুঁসে উঠলো বাংলার প্রতিবাদীজনতা। আর রক্তরাঙা ফাগুনে বিদ্রোহের আগুন জ্বললো সারা বাংলাদেশে। সর্বত্র একই দাবি ও আওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
এখানে, তোমাদের কাছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রদান করছি: জন্মের দিক থেকেও বাংলাভাষা গৌরবের অধিকারী আর তারা অগ্রগামী। আর উর্দুভাষার জন্ম সেদিন। কয়েকটি ভাষা থেকে বর্ণমালা ধার করে জন্ম নিয়েছে উর্দু। আর তা আবার অন্য ভাষাভাষী মানুষের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ারও শয়তানীচক্রান্ত করেছিলো এই পশ্চিমপাকিস্তানী নামক পাপিষ্ঠশাসকবর্গ। তাদের এই ধৃষ্টতার সমুচিত জবাব দিয়েছিলো বাঙালি। ১৯৫২ সালে, পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকরূপী হায়েনাদের বাংলাভাষার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জারী করা ১৪৪-ধারা নামক ‘জারজধারা’কে ভঙ্গ করে বাংলার মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে নেমে এলে পাকিস্তানী-জালেমগোষ্ঠী মাথানত করতে বাধ্য হয়। বাংলাভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুআরি শয়তানী  পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীর শয়তানী-রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিনের স্বৈরাচার পাকিস্তানী-শাসকদের শয়তানী ও জারজনীতির ভিত্তিতে জারী করা ১৪৪-ধারা নামক ‘জারজধারা’কে অমান্য করে রাজপথে নেমে আসে বাংলার দরদীসন্তান: বাংলাপ্রেমিক ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতাসহ সর্বস্তরের ভাষাপ্রেমীমানুষ। পাকিস্তানী-কাফেরবাহিনীর গুলিতে সেদিন রাজপথে শহীদ হয় আমাদের ভাই—এই মাটির পবিত্রসন্তান: রফিক-বরকত-সালাম-জব্বার-শফিউরসহ নাম-না-জানা আরও অনেক দেশপ্রেমিক। কারণ, সেদিনের পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীর সদস্যরা আমাদের অনেক ভাইয়ের লাশ গুম করেছিলো। এভাবে, বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি-জাতি নিজদেশে নিজ-মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত করলো। কিন্তু এতেও পাকিস্তানীদের জঘন্য শয়তানী-চক্রান্ত বন্ধ হলো না। তারা তাদের জারজ-উর্দুভাষাকে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করতে না পেরে—তারা আবার বাঙালিদের বিরুদ্ধে একের-পর-এক সীমাহীন শয়তানী-চক্রান্তে মেতে উঠতে লাগলো। এরপর পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক জালেম-শয়তানগোষ্ঠীর অত্যাচার-অবিচার ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাই, এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য বাংলার নেতৃবৃন্দ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অনড় ও অটল থেকে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে গঠন করলেন ঐতিহাসিক ‘যুক্তফ্রন্ট’। বিভিন্ন দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলেও এর নেতৃত্বে ছিলেন: কৃষক-শ্রমিক-পার্টির নেতা: শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলিমলীগ-নেতা: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ‘পাকিস্তান-মুসলিমলীগ’কে বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তারা পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশে একচ্ছত্র কর্তৃত্বলাভ করে। এই বিপুল বিজয়ের পিছনে তখন থেকেই আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনীনেতৃত্ব বিরাট ভূমিকাপালন করে। নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর যুক্তফ্রন্ট পূর্বপাকিস্তানে সরকারগঠন করলেও নরপশু-পশ্চিমপাকিস্তানীদের শয়তানী-ষড়যন্ত্রের কাছে তা বেশিদিন টিকতে পারেনি। একসময় পশ্চিমপাকিস্তানের শয়তানী কেন্দ্রীয় সরকার নিয়মবহির্ভূতভাবে, অন্যায়ভাবে, বেআইনিভাবে, আর শয়তানীসামরিক আইনের বলে পূর্বপাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট-সরকারকে ভেঙ্গে দেয়। পাকিস্তানে এইসব শয়তানীর মূলে ছিলো: ‘পাকিস্তান-মুসলিমলীগ’। এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ও লোকদেখানো রাজনৈতিক পরিচয়ের খোলসে পশ্চিমপাকিস্তানে গড়ে তুলেছিলো এক-একটা লাঠিয়ালবাহিনী—পেটোয়াবাহিনী—সামরিকবাহিনী। এরা ছিল এক-একটা আস্ত জল্লাদ আর আস্ত কসাই।
তৎকালীন পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক শয়তানগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে শোষণের ভয়াবহ চিত্র:
 
পাকিস্তানরাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানী-শাসকবর্গ বাংলাদেশকে শোষণের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ইংরেজদের সঙ্গে গোপনে এক বিরাট ষড়যন্ত্র করেছিলো। মুসলিমলীগের দালালচক্র এই শয়তানী-ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলো। পশ্চিমপাকিস্তানের চেয়ে সম্পদে-প্রাচুর্যে সবসময় এগিয়ে ছিল পূর্বপাকিস্তান নামক বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ছিল অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এছাড়াও, পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের পাট-চা-চামড়া ইত্যাদি ছিল সবসময় রপ্তানিযোগ্য পণ্য। তা সত্ত্বেও, পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকবর্গ বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য কখনও এখানে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়নি। আর যাও বা আমরা উৎপাদন করতাম তার সবই শকুনের মতো ছোঁ-মেরে নিয়ে যেতো পশ্চিমপাকিস্তানী শকুন-হায়েনাগোষ্ঠী। তাই, সূচনালগ্ন থেকেই পশ্চিমপাকিস্তানী-জালেমগোষ্ঠী আমাদের বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন চায়নি। পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অর্জিত সম্পদ পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকবর্গ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের ভোগবিলাসের ব্যাপক আয়োজন করতো। আর মরুময় পশ্চিমপাকিস্তানের তুলনায় তখন আমরা ছিলাম এবং এখনও আছি শস্য-শ্যামলা-সুজলা-সুফলা। আর দুই পাকিস্তানের রাজস্ব আয়ের ষাট ভাগ জোগান দিতাম আমরা। অথচ, এর থেকে আমাদের জন্য ব্যয় করা হতো মাত্র পঁচিশ ভাগ। পশ্চিমপাকিস্তানের রপ্তানিযোগ্য পণ্যেরও ষাট ভাগ জোগান দিতাম আমরা। তা সত্ত্বেও, ওদের মধ্যে কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না। আর ওরা আমাদের সঙ্গে দিনের-পর-দিন বিমাতাসুলভ আচরণ-প্রকাশ করেছে। আর শিল্পের সমস্ত কাঁচামাল আমাদের বাংলাদেশে উৎপন্ন হলেও এর প্রায় সবই ব্যয় করা হতো পশ্চিমপাকিস্তানে। আর এইসময় পশ্চিমপাকিস্তানেই গড়ে ওঠে সিংহভাগ কলকারখানা। আমাদের দেশের কৃষিখাতকেও অবহেলা করে আমাদের দেশের জন্য কিছুই না-করে তারা আমাদের কৃষিপণ্যের ভোগদখলসহ প্রায় সমুদয় কৃষিঋণ পশ্চিমপাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করতো। আর তারা এমনই জালেম ছিল।
 
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রেও ছিল এক সীমাহীন বৈষম্য। তাই, পাকিস্তানের কৃষি, শিল্প, চিকিৎসা ও বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণাকেন্দ্রের ১৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩টিই ছিল তখনকার পশ্চিমপাকিস্তানে। এভাবে, আমরা সেই সময় শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকি। পশ্চিপাকিস্তানীদের অনৈতিক বৈষম্যের কারণে আমরা বাংলাদেশের মানুষ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সিভিল-সার্ভিসসহ কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির সকল পর্যায়ে ও সামরিকবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এক বিরাট বৈষম্যের শিকার হতেই থাকি। আর এসব চাকরি নগ্নহাতে নিয়ন্ত্রণ করতো পশ্চিমপাকিস্তানী-জাহেলগোষ্ঠী। এছাড়াও, সরকারি-চাকরির সকল ক্ষেত্রে মনোনয়ন-বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই হতো পশ্চিমপাকিস্তানী পাপিষ্ঠ-জালেমগোষ্ঠী। এর ফলে, তাদের এহেন কারসাজি আর শয়তানী-ষড়যন্ত্রে বাঙালিরা উচ্চপদে নিয়োগলাভ করতে পারতো না। তখন সবকিছুতে-সবখানে পশ্চিমপাকিস্তানীদের নির্মম অত্যাচার ও ভয়াবহ শোষণ চলছিলো। মূলত পাকিস্তানীদের কোনো মনুষ্যত্ব ছিল না।
আর তখনই বাঙালি-জাতির পক্ষে বাঙালি-জাতির একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ও নেতা হিসাবে পশ্চিমপাকিস্তানী জালেম-শয়তানগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মাথা-উঁচু করে রুখে দাঁড়ান: আমাদের একমাত্র অভিভাবক ও জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এইসময় উপলব্ধি করলেন: বাঙালি-জাতির স্বার্থে যেকোনোমূল্যে পূর্বপাকিস্তান নামক এই ‘বাংলাদেশ’কে স্বাধীন করতে হবে। আর তা-না-হলে এই জালেমচক্র আর শয়তানগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচা যাবে না। তাই, তিনি পশ্চিমপাকিস্তানীদের কাছে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুআরি লাহোরে এক-সম্মেলনে সুকৌশলে তুলে ধরলেন তাঁর ঐতিহাসিক ‘ছয়দফা’। তিনি সেই সময় ‘ছয়দফা’ পেশ করে বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেন। আর আমাদের এই ‘ছয়দফা-স্বায়ত্তশাসন’ একবার বাস্তবায়িত হলে সেদিনের পূর্বপাকিস্তান নামক ‘বাংলাদেশ’ রক্তপাতহীনভাবে সরাসরি স্বাধীনতালাভ করতে পারতো। এই ‘ছয়দফা’র মধ্যেই লুক্কায়িত ছিলো আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বীজমন্ত্র। তাই, পশ্চিমপাকিস্তানী জালেম-শয়তানগোষ্ঠী ছয়দফার গুরুত্ব বুঝতে পেরে শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করতে থাকে। আর তখন থেকেই তারা আমাদের, বাঙালি-জাতির একমাত্র নেতা: বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ১৯৬৬ সালে, বঙ্গবন্ধু বাঙালি-জাতির সামনে ছয়দফা-পেশ করার পর থেকে বাংলার নেতৃত্ব এককভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের একমাত্র যোগ্য ও বিশ্বস্ত নেতা হিসাবে গ্রহণ করে। আর এই ছয়দফা-পেশ করেই তিনি বাঙালি-জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। এরই ভিত্তিতে দেশস্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুআরি তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সদ্যো স্বাধীন-সার্বভৌম-পবিত্র বাংলাদেশে ফিরে এলে লক্ষ-লক্ষ জনতার মহাসমাবেশে জাতি তাঁর নামে শ্লোগান দেয়:
‘মহান জাতির মহান নেতা—শেখ মুজিব-শেখ মুজিব। মহান জাতির, জাতির পিতা—শেখ মুজিব-শেখ মুজিব। একনেতার একদেশ—বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। এভাবেই একদিন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি-জাতির একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা—বাঙালি-জাতির জনক।
 
পশ্চিমপাকিস্তানী-জালেমশাসকগোষ্ঠীকর্তৃক বাঙালি-জাতির একমাত্র বলিষ্ঠ-কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কুপরিকল্পিতভাবে হত্যার চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র:
 
পাকিস্তানী জালেম-শয়তানগোষ্ঠী তাঁকে নানান শয়তানীউপায়ে হত্যার পরিকল্পনাগ্রহণপূর্বক তা বাস্তবায়নের ঘৃণ্য চক্রান্ত শুরু করে দেয়। এই শয়তানীর ধারাবাহিকতায় পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক কুকুরগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে একেবারে মরীয়া হয়ে ওঠে। তারা পাগলাকুকুরের চেয়েও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এইসময় পশ্চিমপাকিস্তানীদের সার্বিক আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছিলো: তারা বুঝি কুকুর-শূয়রবংশজাত শাসকগোষ্ঠী। তাই, সেই সময় তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এতোটা বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো।
পাকিস্তানী-শয়তানীশাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে কুপরিকল্পিতভাবে ১৯৬৮ সালে আমাদের মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫জন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ‘আগরতলা-ষড়যন্ত্রমামলা’ নামক এক শয়তানী-মামলাদায়ের করে।
১৯৬৮ সালে, পশ্চিমপাকিস্তানী-শয়তানীশাসকগোষ্ঠী আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা-আন্দোলনের একমাত্র নেতা: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ও তাঁর পেশকৃত ছয়দফাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য এক জঘন্য ও শয়তানী ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। ১৯৬৮ সালে, পশ্চিমপাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নামক কাফের-সরকারের পক্ষ থেকে বাঙালি-জাতির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি শয়তানী-মামলাদায়ের করা হয়। এই শয়তানী-মামলার প্রধান আসামী করা হয় আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এটি ছিল শয়তানী-পাকিস্তানীশাসকগোষ্ঠীর শয়তানীউদ্দেশ্যে সাজানো নাটক―রাষ্ট্রদ্রোহিতার শয়তানী-মামলা। সেদিনের পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের নেতৃত্বকে একেবারে ধ্বংস করার জন্য সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে আরও ৩৫জন দেশপ্রেমিককে এই মামলার আসামী করা হয়। আর এই শয়তানী-মামলাদায়ের করে পশ্চিমপাকিস্তানী-শয়তানগোষ্ঠী আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-অভিযোগ-আনয়ন করে বলে যে, আসামীগণ ভারতের যোগসাজশে পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিমপাকিস্তান তথা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে। তারা আরও বলে যে, আসামীগণ নাকি ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের আগরতলায় বসে এই ষড়যন্ত্র করছিলো। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ‘আগরতলা’ নামক স্থানকে কেন্দ্র করে তাঁদের নামে এই জঘন্য, কুখ্যাত ও শয়তানী মামলাদায়ের করা হয় বলে এর নাম ‘আগরতলা-ষড়যন্ত্রমামলা’। আসলে, এর নাম হওয়া উচিত ছিল: ‘পাকিস্তান-ষড়যন্ত্রমূলক-শয়তানীমামলা’। এরপর ইবলিশ শয়তানের আদি-আসল ও একমাত্র দোসর পাকিস্তানীশাসকগোষ্ঠী নামক হায়েনার দল তাদের দায়ের করা শয়তানীপ্রহসনমূলক মামলার শয়তানী ও ষড়যন্ত্রমূলক বিচার-কার্যক্রম শুরু করলো। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল: বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত-ক্যারিজমেটিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে তাঁকে বিচারের নামে হত্যা করা। আর তাঁকে হত্যা করতে পারলে চিরদিন বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা যাবে। সেই শয়তানী ও অপবিত্র উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক নরপশুরা একেবারে মরীয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু এবার তাদের সমস্ত শয়তানী ও ষড়যন্ত্র সমূলে ভেস্তে যায়। সারা বাংলার মানুষ আস্তে-আস্তে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ-প্রতিবাদে ফেটে পড়তে-পড়তে সারা বাংলার মানুষ একসময় প্রতিবাদে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে।
বাংলার সর্বস্তরের মানুষ এইসময় শ্লোগান দিতে থাকে:
 
জেলের তালা ভাঙ্গবো―শেখ মুজিবকে আনবো।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা―তোমার-আমার ঠিকানা।
সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই—দিতে হবে।
ঢাকা না পিন্ডি? ঢাকা-ঢাকা।
 
আমাদের বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা ও শয়তানী মামলাদায়ের করার কারণে ১৯৬৯ সালে, সারা বাংলায় ঘটে যায় ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। আর সেই দিনটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২২-এ ফেব্রুআরি। মুক্তি পান বাঙালির প্রাণপ্রিয়-একমাত্র নেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজবন্দী। আর সেই গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যায় সেদিনের পাকিস্তানীশাসক, সামরিকজান্তা ও শয়তানপুত্র আইয়ুব খান। এরপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতাদখল করে আরেক শয়তানের জারজপুত্র, পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ নাজায়েজসন্তান, শয়তানকুলশিরোমণি ও স্বঘোষিত জেনারেল ইয়াহিয়া খান হারামজাদা।
 
এরপর পাকিস্তানীদের এই শয়তানী-ষড়যন্ত্রমূলক মামলা থেকে মুক্তিলাভের পর বাঙালির একমাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৯ সালের ২৩-এ ফেব্রুআরি বাংলার লক্ষ-লক্ষ জনতা ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স-ময়দানে তথা আজকের সোহরাওয়ার্দী-উদ্যানে এক বিশাল গণসংবর্ধনা প্রদান করে। আর এখানেই তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
 
জেলমুক্তির পর ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর বাঙালির মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক বিশাল জনসভায় আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দিলেন: ‘এখন থেকে আর পূর্বপাকিস্তান নয়, ‘বাংলাদেশ’ নামে ডাকতে হবে এ-দেশকে’। আর তাঁর এই ঘোষণা শুনেই আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো পশ্চিমপাকিস্তানী নামক রক্তচোষা ড্রাকুলা ও ভ্যাম্পায়ারসদৃশ বিজাতীয় গোষ্ঠী। পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক কসাইগোষ্ঠী আমাদের চিরদিনের মতো দাবিয়ে রাখার জন্য এরপর একের-পর-এক তাদের শয়তানী-ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অব্যাহত রাখলো। আর এইসময় পাকিস্তানে সংঘটিত যাবতীয় শয়তানীর মূলে ছিল নতুন সামরিকজান্তা—উড়ে এসে জুড়ে বসা কুখ্যাত পাপিষ্ঠ, কালসাপ, শয়তানের চিরদোসর, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার, পাপিষ্ঠবংশজাত পাপী, পাপিষ্ঠপাপাত্মা, দুরাচারী, ব্যভিচারীজীবাত্মা, কমজাত, ক্ষমতালোভী, শকুন ও স্বঘোষিত জেনারেল ইয়াহিয়া।
এই শয়তানের অধীনে ১৯৭০ সালে দুই পাকিস্তান মিলিয়ে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের জাতীয় সাধারণ নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয় বাংলাদেশআওয়ামীলীগ। তারা কেন্দ্রীয় পরিষদে আসন পায় ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আর প্রাদেশিক পরিষদে আসন লাভ করে ৩০০টির মধ্যে ২৮৮টি। তবুও তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়নি পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক শয়তানপুত্ররা। এইসময় গণতান্ত্রিকপ্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শুরু হয় একের-পর-এক চক্রান্ত। পৃথিবীর নিয়মঅনুযায়ী, পাকিস্তানের নিয়মঅনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে দুই পাকিস্তানে সরকারগঠন করবে আওয়ামীলীগ। কিন্তু তা-না-করে পাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী নামক সেদিনের কালশয়তানের বংশোদ্ভূত আদি-আসল শয়তানরা বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে থাকে। তারা বাঙালি-জাতির হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিতে নানান টালবাহানা ও শয়তানী শুরু করে দেয়। আর তারা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিবিধ আলোচনার নামে কালক্ষেপন করতে থাকে। আর ভিতরে-ভিতরে চলতে থাকে তাদের শয়তানী-অপকর্মসাধনের আরও নানান ষড়যন্ত্র।
১৯৭০ সালের জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে পূর্বপাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ। আর তাদের হাতে এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এটাই চিরায়ত নিয়ম, আইনকানুন ও প্রথা। কিন্তু তা-না-করে সেদিনের পশ্চিমপাকিস্তানী নামক হায়েনাগোষ্ঠী বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে নানান শয়তানী শুরু করে নিজেদের গভীর ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নিতে থাকে। আর আমাদের, বাঙালিদের ভিতরে-ভিতরে নিধনের শয়তানী-চক্রান্ত করতে থাকে। কিন্তু নিরীহ ও ভালোমানুষ বাঙালি-জাতি পশ্চিমপাকিস্তানী-হায়েনাদের সেই শয়তানীপরিকল্পনা তখনও বুঝতে পারেননি। ওরা যে শয়তানী করবে, তা আমাদের নেতৃবৃন্দ জানতেন। কিন্তু ওরা যে, এতোটা ভয়াবহ আর নৃশংসতম শয়তানী করবে তা কেউই ভাবতে পারেননি।
এইরকম জঘন্য শয়তানী করতে যখন পশ্চিমপাকিস্তানী-শাসকগোষ্ঠী ব্যস্ত, তখন ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ‘রমনা-রেসকোর্স-ময়দানে’ এক ঐতিহাসিক ভাষণ-প্রদান করলেন আমাদের বিশ্বস্তনেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেখানে তিনি প্রথম-দফায় খুব কৌশলে বাংলার স্বাধীনতাঘোষণা করলেন। ওই ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু হিকমতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিবাহিনীগঠনের ইঙ্গিত-প্রদান করলেন। তিনি এক আধ্যাত্মিক সাধকের মতো বুঝে গেলেন: পশ্চিমপাকিস্তানী নামক নরপশুরা আমাদের হাতে কখনওই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-প্রদান করবে না, এবং তারা আমাদের স্বাধীনতাও মেনে নেবে না। এর জন্য আমাদের রক্ত দিতে হবে। আর তাঁকেও বিনাকারণে যে-কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করা হতে পারে। তাই, তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ত্রিশ-লক্ষাধিক বাঙালির বিশালবিরাট এক মহাসমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘোষণা-প্রদান করতে বাধ্য হলেন। আর তিনি প্রকৃত সিংহপুরুষের মতো গর্জে উঠলেন। আর জলদগম্ভীরস্বরে বললেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। প্রচণ্ড সাহসিকতায় পূর্ণ এমন একটা ভাষণ সমগ্র পৃথিবীতে আজও বিরল।
এরপর বাংলার মুক্তিকামীমানুষ বুঝে গেল তাদের এবার কী করতে হবে। নেতা কী বলেছেন, তা বুঝতে কারও আর বাকি রইলো না। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সারাবাংলার স্থানে-স্থানে গড়ে উঠলো ‘সংগ্রাম-পরিষদ’। শুরু হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতিগ্রহণ। একদিকে চলছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিশাল প্রস্তুতি—অপরদিকে আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী দেশী ও আন্তর্জাতিক শয়তানগোষ্ঠী আর লম্পটচক্র পাকিস্তানশয়তানের পক্ষে বিরাট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলো: সেদিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির সরকারপ্রধান তথা প্রেসিডেন্ট ও শয়তানের জারজপুত্র রিচার্ড নিক্সন এবং তদীয় শিষ্য-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বশয়তান ও শয়তানের আরেক জারজপুত্র হেনরী কিসিঞ্জার। এছাড়াও, সেই সময় আমাদের বাংলাদেশের পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রবল বিরোধিতাকারী দেশগুলো হচ্ছে: চীন, সৌদিআরব, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, কানাডা ও লিবিয়া। এরা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিতভাবে সেদিন বাংলাদেশকে ধ্বংস করে এখানে পাকিস্তানের শয়তানতন্ত্রের ও জারজতন্ত্রের বীজ-রোপণ করতে চেয়েছিলো।
আর তখন শান্তিপ্রিয় বাংলার মানুষ কিছু-একটা বুঝে উঠতে-না-উঠতেই সেই ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী নরখাদক, নারীখাদক, রক্তলোলুপ, নরপশু, হায়েনা, রক্তপিশাচ, পাপাচারী, ব্যভিচারী, এজিদগোষ্ঠী কাপুরুষের মতো সেদিনের সম্পূর্ণ নিরস্ত্র বাঙালি-জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওরা এমনই ভয়াবহ শয়তান ছিল যে, সেদিন বাংলাদেশে জনসমর্থন আদায় করতে পবিত্র ইসলামধর্মের দোহাই দিয়ে প্রচার করতে থাকে: ইসলামের স্বার্থে নাকি পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’কে আক্রমণ করেছে। আর পাকিস্তান যা-কিছু করছে—তা নাকি ইসলামধর্ম-রক্ষা করতেই করছে। আর সেদিনের পশ্চিমপাকিস্তানের অবৈধ, পাপিষ্ঠ ও জারজ শাসকগোষ্ঠী আমাদের মহান স্বাধীনতা-আন্দোলনকে ‘কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাস’ বলে বহির্বিশ্বে অপপ্রচার চালাতে থাকে। কিন্তু সেদিন পৃথিবীর সমস্ত শয়তানের এই শয়তানীচক্রান্তের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে রুখে দাঁড়ায় সমগ্র বাঙালি-জাতি—আর বাঙালিরা তাদের মুখে প্রবল ঘৃণায় থুথু ছিটিয়ে স্বাধীন করে বাংলাদেশ।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নিকৃষ্ট মানুষ ও জাতি নাই—যারা পাকিস্তানীদের মতো ঘুমন্ত মানুষের উপর আক্রমণ-পরিচালনা করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ রাতে পাপিষ্ঠ, কমজাত, পাপাচারী, পাতক, নরপিশাচ, নরঘাতক, ব্যভিচারী, বেজন্মা পাকিস্তানীরা সেই কাজটিই করেছিলো। আর তখন, পাকিস্তানীদের এই শয়তানীর বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশে রুখে দাঁড়ায় নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালি। আর দেখতে-দেখতে তারা একেকজন হয়ে ওঠে বিরাট-বিরাট মুক্তিযোদ্ধা। এভাবেই শুরু হয়ে গেল পশ্চিমপাকিস্তানীদের বিশ্বশয়তানীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ-সংগ্রাম। শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা।
আর এই কালরাত্রিতেই গ্রেফতার করা হলো বাঙালি-জাতির একমাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬-এ মার্চ রাত্রির প্রথমভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় দফায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘোষণা করলেন। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে শুরু হলো পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ—শুরু হলো পাকিস্তানী-শয়তানী হানাদারবাহিনী নামক শূয়রবাহিনীর বিরুদ্ধে বীর-বাঙালির মানবতাপ্রতিষ্ঠার জনযুদ্ধ।
 
পাকিস্তানরাষ্ট্রটি কোনোদিন মানুষশাসিত ছিল না। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, মানুষের দ্বারা পাকিস্তানরাষ্ট্রটি কখনও শাসিত হয়নি। এই চিহ্নিত শয়তানরা দুই পাকিস্তানকে নিজেদের ভোগবিলাসের শয়তানী-আস্তানা বানিয়ে রেখেছিলো। এর মধ্যে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট-নির্বাচনের পর পূর্বপাকিস্তানে নবগঠিত সরকার মাত্র কিছুদিনের জন্য বাঙালিদের পক্ষে কাজ করতে পেরেছিলো। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে পশ্চিমপাকিস্তানীরা আবার আমাদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। পাকিস্তানীরা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সামরিকতন্ত্র নামক শয়তানতন্ত্র-জারজতন্ত্র দ্বারা পাকিস্তানকে পরিচালনা করেছে। এই বিশ্বে পাকিস্তানই প্রথম গণতন্ত্রের পরিবর্তে, গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে, গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে তৎপরিবর্তে সামরিকতন্ত্র-জারজতন্ত্রের মাধ্যমে দীর্ঘকালযাবৎ দুই পাকিস্তানকে শাসনের নামে সীমাহীন শোষণ করেছে। তাই, তাদের এহেন যাবতীয় শয়তানী কোনোভাবেই বাঙালি-জাতি মেনে নিতে পারেনি। আর ওদের রাশি-রাশি শয়তানী-বদমাইশী শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা মানতে পারেনি বলেই ১৯৭১ সালে তারা আত্মরক্ষার্থে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একসময় আমাদের বীর-বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্র-জারজতন্ত্র একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। মূলত তৎকালীন পাকিস্তানী স্বৈরাচারী-শাসকগোষ্ঠী ছিল এজিদবংশীয় জারজশক্তি। তাই, তারা আইনকানুন ও ইসলামী রীতিনীতিকে বাদ দিয়ে শয়তানী জারজরীতিনীতির ভিত্তিতে পাকিস্তান পরিচালনা করতো। আর তাই, তারা এভাবে নির্লজ্জ-কাপুরুষের মতো ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ রাতের আঁধারে আমাদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। আর পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এইরকম জঘন্য শয়তানী আক্রমণের কোনো নজির নাই। পাকিস্তানীরা আজও এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কুখ্যাত আগ্রাসী-অপশক্তি এবং সবসময়ের জন্য একেবারে মানবতাবিরোধী-নরপশুগোষ্ঠী।
১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ একতরফা বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে কাপুরুষ পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ এর জেলায়-জেলায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালে-পালে, ঝাঁকে-ঝাঁকে নেমে এলো—ঠিক সাঁঝের শূয়রের মতো। আমরা অবশ্য এদের শুধু পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনী না বলে এদের সরাসরি পাকিস্তানী-শূয়রবাহিনী বলেও অভিহিত করতে পারি। তার কারণ, হানাদারবাহিনীদের মধ্যে যে-সমস্ত বদস্বভাব থাকে তারচেয়েও বেশি বদস্বভাব ছিল এই কুখ্যাত পাকিস্তানী-শূয়রবাহিনীর মধ্যে। তাই, ১৯৭১ সালের পাকবাহিনীকে পাকিস্তানী-শূয়রবাহিনী বলাই ভালো। সাঁঝের শূয়রগুলো খুব ক্ষুধার্ত আর ক্ষিপ্ত হয়। এরা কোনো বাচবিচার করে না। এরা এই সময়টাতে খুব ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকে বলে কোনোদিকে না তাকিয়ে সমানে কচু-ঘেচুসহ সামনে যা পায় তা-ই খুঁজতে থাকে,  এবং তা নির্বিচারে সাবাড় করতে থাকে। এইসময় তাদের সামনে কোনো মানুষজন পড়লে আর তাদের রক্ষা নাই। ১৯৭১ সালের বিশ্বকুখ্যাত ও বিশ্বজঘন্য পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীও ছিল সাঁঝের শূয়রের মতো ক্ষিপ্ত। তাই, তারা বাংলার শান্ত গ্রামগুলোকে ক্ষিপ্ত শূয়রের মতো চষে-চষে নির্বিচারে মানুষ-মারতে শুরু করলো। আর আমাদের পবিত্র নারীদের ধর্ষণ করতে শুরু করলো। কিন্তু তোমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে: তারা এতোকিছু করলো কীভাবে?
হ্যাঁ, তারাই সবকিছু করেছে। তবে তাদের সহায়তা করেছে এদেশীয় কিছুসংখ্যক দালাল, জাতীয় কুলাঙ্গার, ইসলামবিরোধী ওহাবী-খারিজী-মওদুদীবাদী, দেশদ্রোহী, পাকিস্তানবাদী-জাহান্নামবাদী এক শয়তানগোষ্ঠী। আর তারা সেদিন নিজেদের মুসলমানিত্ববিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানী-হানাদারবাহিনীকে ‘বাপ’ ডেকে পাকিস্তানরক্ষা করতে চেয়েছিলো। তারা এমনই কুলাঙ্গার যে, তারা এই দেশে জন্মে, এই দেশের আলো-বাতাসে বড় হয়ে, এই দেশের খেয়ে-পরে, এই দেশের বিরুদ্ধেই অস্ত্রধারণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি। তোমরা মনে রেখো: ১৯৭১ সালে, একশ্রেণীর পাকিস্তানের দালাল বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে পবিত্র ইসলামধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানকে বাঁচাতে সগৌরবে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছিলো। আর এই শয়তানরা বলেছিলো: ‘পাকিস্তান আর ইসলাম এক। তাই, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে।’ এরা আরও মনে করেছিলো: ‘পবিত্র কাবাঘরকে সিজদাহ না করে পাকিস্তানকে সিজদাহ করলেও চলবে’। তাই, তারা সগৌরবে পাকিস্তানকে নিজেদের কেবলা বানিয়ে তাকে রক্ষা করতে, নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করার জন্য পাকবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করতে লাগলো। পাকবাহিনী আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-আওয়ামীলীগারদের ঘরবাড়ি ইত্যাদি কোনোকিছুই চিনতো না। এইসবকিছু জারজ পাকিস্তানীদের চিনিয়ে দিয়েছে এই দেশের একশ্রেণীর জাতীয় কুলাঙ্গার—কথিত শান্তিকমিটির সদস্য, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস। এরা পশুরও অধম। এরা বাংলার চিরশত্রু ও জারজসন্তান। এদের কোনো ধর্ম নাই। এরা ১৯৭১ সালের এজিদবংশোদ্ভূত পাকিস্তানী-এজিদবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। আর সেদিন এদের কারও কোনো ধর্ম ছিল না। কিন্তু এরা সবাই ছিল নামধারী-মুসলমান। এরা সেদিন বাংলাদেশের মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। আর এদের কারও মধ্যেই বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব ছিল না।
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশে আগত আর বাংলাদেশরাষ্ট্রকে রাতের আঁধারে অতর্কিতে আক্রমণকারী পাকিস্তানী-আর্মিদের সবাই ছিল মুসলমান! আর এদের চিরগোলাম ও চিরদোসররা—মানে, পাকিস্তানী-দালালরাও মুসলমান ছিল! কিন্তু আমরা কী দেখেছি এদের মধ্যে? এদের নামটা হয়তো মুসলমানদের মতো ছিল। কিন্তু এরা ছিল এক-একটা আস্ত কাফের। এরা ছিল কাফেরবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। সেইজন্য এরা ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ ঘুমন্ত বাঙালি-জাতির উপর এই ঘৃণ্য ও জঘন্য হামলা পরিচালনা করতে পেরেছিলো। তাই, ১৯৭১ সালে এই পাকিস্তানী কাফের-সরকারের কাফের-আর্মিবাহিনীর সবসময় টার্গেট ছিল: বাংলাদেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ, মানুষের জানমাল আর নারীদেহ। মূলত এরা মানুষহত্যা করে এই বাংলাদেশকে ওদের চিরদিনের কাঙ্ক্ষিত: গোলামরাজ্য, করদরাজ্য, প্রজারাজ্য, ভোগরাজ্য, হেরেমখানা বানাতে চেয়েছিলো। সেদিন ওদের কারও কোনো ধর্ম ছিল না বলেই ওরা এভাবে একের-পর-এক মানুষহত্যা করতে পেরেছিলো। এই হলো পাকিস্তানীমুসলমানদের আদি-আসল চেহারা।
পাকিস্তানে কোনোদিন মানুষশাসিত-সরকার ছিল না। ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তান নামক এই শয়তানরাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে এটি পালাক্রমে বিজাতীয়, বেজন্মা ও শয়তানপুত্রদের দ্বারা বারবার শাসিত হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিকজান্তা নামক শয়তানের জারজপুত্রগুলো বারবার ইসলামধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাদখল করেছে। এক-শয়তান বিদায় নিয়েছে তো সঙ্গে-সঙ্গে আরেক শয়তান এর গদীতে বসেছে। এখানে, আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা ছিল না। পাকিস্তানের বেআদব শাসককুল কখনও না রাষ্ট্রের আইন—আর না ইসলামী আইনকে মেনেছে। বরং তারা বারবার ইসলামবিরোধী শয়তানী-কর্মসাধনের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন করেছে। আর বাংলাদেশের মানুষের উপর বারবার সীমাহীন জুলুমনির্যাতন করেছে। আর তারা তাদের মনগড়া শয়তানী-আইনবলে পাকিস্তান-শাসন করে আবার তাকেই ‘ইসলামীআইন’ ঘোষণাপূর্বক ইসলামবিরোধী কাজ করেছে। তারা নিজেদের স্বার্থে নিজেদের বানানো আইনকে বারবার ‘ইসলামীআইন’ বলে পবিত্র ইসলামের চরম অবমাননা করেছে। এককথায়: তাদের ধৃষ্টতার কোনো শেষ নাই। তাই, আমি দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলতে চাই: একদা শয়তানপুত্রদের গভীর ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট বিশ্বের বুকে ‘পাকিস্তান’ নামক একটি শয়তানরাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এই পাকিস্তান-ফাঁকিস্থান-কাফেরস্থান নামক শয়তানরাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয় একঝাঁক শয়তানপুত্র। সেই সময় কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শীতার কারণে ‘বাংলাদেশ’ পূর্বপাকিস্তান নামধারণপূর্বক পশ্চিমপাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই সময় বাংলাদেশআওয়ামীলীগের জন্ম হলে কোনোভাবেই এমনটি ঘটতো না। তাই, ১৯৪৯ সালে, বাংলাদেশে ‘আওয়ামীলীগে’র জন্ম হলে তারা জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের তথা পশ্চিমপাকিস্তানীদের সমস্ত শয়তানীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই শুরু করে। আর এভাবেই একসময় বাংলাদেশআওয়ামীলীগ বাংলার গণমানুষের কাছে একমাত্র রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
যা হোক, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিতপ্রয়াসে—তীব্র আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল স্বাধীন-বাংলাদেশের ‘মুজিবনগরে’ গঠিত হলো বাংলাদেশের ‘মুজিবনগর-সরকার’। এটি স্বাধীনতা-ঘোষণাকারী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই সরকারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন: আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন: তাজউদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন: এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী প্রমুখ। মূলত বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এই চার-জাতীয় নেতাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে লাগলেন। এইসময় আনুষ্ঠানিকভাবে আরেক-দফায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘোষণা করা হলো। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল নবগঠিত ‘মুজিবনগর-সরকারে’র অধীনেই গঠিত হলো এক শক্তিশালী ‘মুক্তিবাহিনী’। এই মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন: আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এর সেনাধ্যক্ষ বা সেনাপতি নির্বাচিত হলেন: কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী। আর এর উপপ্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হলেন: বিমানবাহিনীর উর্ধ্বতন এক অফিসার এ.কে. খন্দকার। এখানে, তোমাদের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখতে চাই যে, অনেকে ভুল করে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে শয়তানী করার জন্য কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে থাকে—যা সম্পূর্ণ ভুল এবং তা নিশ্চিতভাবে মূর্খতা। কারণ, একটি দেশের সেনাবাহিনীর বা দেশরক্ষার নিমিত্তে নিয়োজিত অন্য যেকোনো বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদটি সংরক্ষিত থাকে সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান বা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাই, এক্ষেত্রে তোমরা কোনো সময় এই ভুলটি কোরো না। আরও মনে রাখবে: এই বাংলাদেশে যারা আজও বলে আর বিভ্রান্তি ছড়ায় ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের সময় কর্নেল ওসমানী কেন ঢাকার রেসকোর্স-ময়দানে উপস্থিত ছিল না—তারা বাংলাদেশবিরোধীশয়তান তথা স্বাধীনতাবিরোধীঅপশক্তি। পরে তোমাদের কাছে এ-সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে বলা হবে।”
 
এই পর্যন্ত বলে লিটু মিয়া একটু থামলেন। আর তিনি দেখলেন, ঘরের সবাই মুগ্ধতার সঙ্গে তার সবকথা শুনছে। তারপর তিনি সবার দিকে চেয়ে বলতে লাগলেন, “এবার তোমাদের কাছে পাকিস্তানের শয়তানপুত্রদের নামধামসহ ১৯৭১ সালে সংঘটিত পাকবাহিনীর নৃশংস অত্যাচারনির্যাতনের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরবো। আশা করি, তোমরা আগের মতোই শুনবে।”
 
 
(চলবে)
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ
২৬/১০/২০১৭ 

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক তারিখঃ 26/10/2017
সর্বমোট 10702 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন