ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ভ্রমণকথাঃ বছর শেষে মেঘের দেশে (২য় পর্ব)

গতকাল রাত থেকে জার্নির ধকল, তাই গোসল করাটা জরুরি। তবে পানি বেশ ঠাণ্ডা। কিচ্ছু করার নেই, অভ্যেস না থাকলেও আজ সেই ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল সেরে নিলাম। স্ত্রী-মেয়েকে বললাম তোমরা গোসল করে রেডি হও, আমি একটু ঘুরে আসছি। মাসুদ ভাইও রেডি হচ্ছেন। আমি চারপাশটা একটু দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রকৃতির পাশাপাশি স্থানীয় আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনযাত্রার প্রতিও আমার কিছুটা আগ্রহ আছে।
      সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া। রুইলুই পাড়ায় ঢুকে কিছুদূর এগিয়েই সাজেকের মূল পর্যটন এরিয়া শুরু। এই স্থানটা মূলতঃ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত। সাজেকের শুরুতেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিজিবি ক্যাম্প। এখানে একটি হেলিপ্যাড আছে। আরও সামনে এগোলে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যে গ্রামটি দেখা যায় ওটাই সাজেকের শেষ গ্রাম, নাম কংলাক পাড়া। বিকেলে আমরা কংলাক পাহাড়ে যাবো। সাজেকে প্রচুর হোটেল আর রিসোর্ট হয়েছে; এখানকার ঘরগুলো বেশির ভাগই লাল-নীল-সবুজে রাঙানো। কিছু পাকা বিল্ডিং আর বেশ কিছু টিন আর ছনের তৈরি কটেজ। বেশির ভাগ হোটেল রিসোর্টেই রয়েছে পাহাড়ের দিকে মুখ করা ঝুল বারান্দা, যেখান থেকে দূরে তাকালে সবুজ পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। ফুটপাথের পাশে নানান রকম ফলমুল আর শাক সব্জি নিয়ে বসেছে আদিবাসী নারী-পুরুষ। এ সবই তাদের নিজস্ব বাগানে ফলানো। হোটেলে ফিরে দেখি মাসুদ ভাই তৈরি হয়ে গেছে। মেয়েরা খোলা ছাদে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা লাঞ্চে যাব।
     সবাই তৈরি হয়ে এলে আমরা লাঞ্চে বের হলাম।  হোটেলে পৌঁছেই দুপুরের খাবার বুকিং দিয়ে গিয়েছিলাম। এখানে আগে থেকে বুকিং দিয়ে না রাখলে খাবার পাওয়া কষ্টকর। খাবার দামটাও কিছুটা বেশি। আমার হাঁসের মাংস খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো, তবে মেয়েরা কেউ খেতে রাজি ছিল না, তাই মুরগি, সবজি, আলু ভর্তা, ডাল বুকিং দেয়া ছিলো। আমরা হোটেলে পৌঁছে দেখি- প্রচুর ভিড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর টেবিল খালি পাওয়া গেলো। খেতে গিয়ে কেউ তেমন খুশি হতে পারলো না। তাদের কাছে খাবার মজা লাগেনি। লম্বা জার্নির পর পেটে বেশ ক্ষুধা ছিল, তাই আমার তেমন খারাপ লাগেনি। যাই হোক, লাঞ্চ শেষে আমরা আশপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। রাস্তার দু’দিকে যেখানেই তাকাই শুধু সবুজ পাহাড়। অবশ্য এমনটাই তো হবার কথা! এখন তো আর মেঘ দেখা যাবে না। মেঘ দেখার জন্য আগামীকাল সকালটা বরাদ্দ থাক। আমরা হোটেলেই ফিরে গেলাম। কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।
     কেউ কেউ শুয়ে রেস্ট নিলেও আমি খোলা ছাদে চলে এলাম। এখান থেকে সাজেকের একপাশের পুরোটা দেখা যায়। পাহাড়ে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য লাল-নীল-সবুজ রঙ করা কাঠ আর টিনের তৈরি কটেজ, যেখান থেকেও এই মেঘের রাজ্যের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমার মেয়ে পেছনে এসে দাঁড়ালো। বাবা, ঐদিকটায় কি? আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো। আমি বললাম- ওদিকটায় ভারতের মিজোরাম। সে বেশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো- ভারত এত কাছে? আই বললাম- হ্যা, আমরা এখন ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারের কাছাকাছি। একে একে অন্যরাও ছাদে এসে দাঁড়ালো। মাসুদ ভাই বললো- চলেন কংলাকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি, আবার ফিরতে হবে তো।
                                     
                                                                  মেয়েদের কংলাক পাহাড়ে ওঠা
 
     আমরা বেরিয়ে পড়লাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। আমাদের সেই মাহিন্দ্র হোটেলের সামনেই দাঁড়ানো। সবাই উঠে বসলে চাপাই মারমা গাড়ি ছেড়ে দিলো। বাবু জানালো এদিকে একটা হেলিপ্যাড আছে, তবে আমরা সেখানে না গিয়ে আরও সামনে কংলাকের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। ওখান থেকে ফিরে হেলিপ্যাডে যাবো। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি থেমে গেলো। বাবু জানালো- গাড়ি আর যাবে না, এবার হেঁটেই যেতে হবে। কি আর করা! আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। এখান থেকেই পাহাড়ে ওঠা শুরু। পথে দেখা গেলো কয়েকজন বাঁশের লাঠি বিক্রি করছে। দেখলাম যারাই পাহাড়ে উঠছে সবার হাতে বাঁশের লাঠি। আমরা প্রত্যেকে একটা করে লাঠি নিয়ে নিলাম। মাটির রাস্তা ধরে উঁচুনিচু পথে এগিয়ে চললাম। আমরা  ক্রমশঃ উপরে উঠছিলাম আর পথের দু’পাশে ভয়ঙ্কর সুন্দর সবুজ পাহাড়ের মাঝে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বাচ্চারা সবার আগে আগে উৎফুল্ল চিত্তে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। যেন এটা একটা মজার খেলা। আমি সবার পেছনে পেছনে যাচ্ছিলাম এবং ওদের থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ছিলাম, কারণ আমি সামনে এগোচ্ছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। যেদিকেই তাকাচ্ছি, মনে হচ্ছে এ জায়গাটার ছবি তুলে রাখি। ওরা বেশ সামনে চলে গেছে। আমি কিছুটা দ্রুত ছুটতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম। একসময় ওদের ধরে ফেললাম। লাঠিসোঁটাসহ ওদের কিছু ছবি তুলে রাখলাম। কিছুটা রেস্ট নিয়ে আবার এগিয়ে চলা। একসময় চূড়ার কিছুটা আগে সবচেয়ে উঁচু খাঁড়া অংশের গোরায় উঠে আসলাম, তবে এর পরের পথটা বাচ্চাদের যাওয়ার উপযোগী নয়। তাই আমরা আর এগোলাম না। ওখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। পাহাড়ের চূড়ায় কংলাক গ্রামে আর যাওয়া হলো না আমাদের। এ নিয়ে আফসোস নেই, বাচ্চারা বেশ মজা পেয়েছে, এতেই খুশি। নামতে গিয়ে আমাদের বেশ সাবধানী হতে হলো। ওঠাটা কঠিন ছিলো, তবে নামাটা যতটা সহজ ভাবছিলাম ঠিক ততটা নয়। কোথাও কোথাও বেশ খাঁড়া। একটু অসাবধান হলে বিপদ হতে পারে, তাই বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। নামার সময় লাঠিটা বেশ কাজে দিয়েছে। এভাবেই একসময় নেমে এলাম। আমাদের কংলাক ভ্রমণ শেষ।
     হোটেলের সামনে এসে বাচ্চারা সেই বাঁশের চা খাওয়ার বায়না ধরলো। সবাই মিলে চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানির বাঁশের চা বানানোর কৌশল দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। একটা বাঁশের চোঙায় দুধ-চিনি দিয়ে তার মধ্যে গরম চায়ের পানি ঢেলে দিলো, তারপর চিকণ বাঁশের কঞ্চির তৈরি এক ধরনের ঘুটনি দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি আর মাসুদ ভাই হাসলাম। এই তাহলে বাঁশের চা! তবে বাচ্চারা বেশ মজা পাচ্ছিলো। বাঁশের চা খাওয়া শেষ, এবার কি করা যায়? চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, এখন কোথাও গিয়ে লাভ নেই। চাপাই মারমা জানতে চাইলো- রাতের খাবার কোথায় খাবো। আমরা দুপুরে যেখানে খেয়েছি সেখানে আর খেতে চাইলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- নতুন ধরণের খাবার কোথায় আছে? পেদা টিন টিনে যেতে পারেন, ওখানে ব্যাম্বু-চিকেন পাওয়া যায়। সবাই ব্যাম্বু-চিকেন খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। আমি আর মাসুদ ভাই চললাম ব্যাম্বু-চিকেনের বুকিং দিতে। অনেকটা পথ হাঁটতে হলো, তবে রাতের খাবারের বুকিং দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। আমি ছাদে গিয়ে বসলাম। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। ঢাকায় শীত এখনও শুরু হয়নি কিন্তু সাজেকে বেশ শীত। ব্লেজারের সাথে মাফিলারও পড়তে হচ্ছে।
     মাসুদ ভাইকে ছাদে দেখে আমি বলে উঠলাম- ইটালিয়ান জ্যাকেট পরে তো দেখি পুরাই প্যাকেট হয়ে গেছেন! মাসুদ ভাই হেসে বললো- শীত তো কম না। আমার মেয়েকেও সোয়েটার টুপি, গলাবন্ধ পরিয়ে দিয়েছে তার মা। দূরে কুয়াশা জমেছে, ছাদ থেকে এখন আবছাভাবে পাহাড় দেখা যায়, তবে মেঘের দেখা এখনও পাইনি। হোটেলের বয়টাকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো- কাল সকালে দেখতে পাবেন। আমি জানতে চাইলাম- ক’টায় উঠতে হবে? সাড়ে পাঁচটায় উঠলেই দেখতে পাবেন। আমি মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখলাম। রাতে পেদা টিন টিনে খেতে গিয়েও দুপুরের মত হতাশ হতে হলো। সব্জিটাই যা একটু মজা হয়েছে, বাকী রান্নাটা যাচ্ছে-তাই। ব্যাম্বু-চিকেন কারো কাছেই মজা লাগেনি। যাই হোক, রাতের খাবার শেষে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম এবং সকালে মেঘ দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
      এলার্ম বাজবার আগেই ভোর পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। মেঘ দেখার লোভে কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে বেরিয়ে অনুভব করলাম ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ। কুয়াশাও জমেছে। চারপাশ ঘোলাটে লাগছে এখন। সামনে তাকিয়ে দেখলাম কোন সবুজের চিহ্ন নেই, সামনের পুরা এলাকাই সাদা। আমি কিছু ছবি তুললাম, তবে কুয়াশার জন্য মেঘ ভালমত দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে আবছায়া আঁধার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম লোকজনের সাড়া নেই। আমি তখনকার মত ভেতরে চলে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম ঘণ্টাখানেক পরে উঠে মেঘ দেখবো।
                         
                                                    হোটেল রুমের সামনের ছাদ থেকে তোলা মেঘের ছবি
 
     মেয়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেলো আবার। বাবা, মেঘ দেখবে না? দেখো কি সুন্দর মেঘ জমেছে! আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম- তুমি দেখেছো? তাকে খুব উচ্ছ্বাসিত দেখে বুঝলাম- সে মেঘ দেখে খুব খুশি। ওর এই আনন্দে আমিও খুশি। আবার কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ছাদে গিয়ে আমি নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম। ভোরে যখন এখানে এসেছিলাম তখন একেবারেই বোঝা যায়নি। এখন দেখছি আমি একটা মেঘের নদীর সামনে দাঁড়িয়ে! কী অসাধারণ ! আমাদের সামনে যে সবুজ গিরিখাতটা ছিলো সেটা এখন নেই! ওখানে শুধু তুলোর মত সাদা মেঘ। দূরের পাহাড়গুলোও মেঘে ঢেকে আছে। আমার মনে হলো এই যে এত পরিশ্রম, ধকল সহ্য করে আমরা এতদূর এলাম- সেটা এখন সার্থক হলো। এদিকে-ওদিকে যেদিকেই তাকাই একটা নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ; মনে হচ্ছে একটা মেঘের নদী বহুদূর পর্যন্ত বয়ে গেছে। আকাশ-পাহাড় আর মেঘের অদ্ভুত এক মেলবন্ধন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি, সবুজ পাহাড় আর মেঘের মিতালী দেখি। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। তারপর বেশ কিছু ছবি তুললাম। চারিদক পরিষ্কার হয়ে এসেছে তবে সূর্য এখনও ওঠেনি। আমরা অপেক্ষা করছিলাম সুর্য ওঠার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘ-কুয়াশার চাঁদর সরিয়ে পূব দিগন্তে সূর্য যখন উঁকি দিলো আমার মেয়ের সে কী আনন্দ! সে পুরো দৃশ্যটি ভিডিও করতে শুরু করলো। সূর্য একটু একটু করে বড় হতে হতে যখন গোল থালার মত রুপ নিলো- সে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো- দেখো বাবা, কেমন লাল টুকটুকে সূর্য উঠেছে! তখনই আমার মনে পড়লো- এই প্রথম সে সূর্যোদয় দেখছে। মাসুদ ভাইয়ের মেয়েরাও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের মাত্রাও কম নয়, হয়তো এটা ওদেরও প্রথম সূর্যোদয় দেখা।
 
                          
                                                                                               সাজেকে সূর্যোদয়
 
      মেঘকন্যা সাজেকে আমাদের সময় ফুরিয়ে এলো, এবার ফেরার পালা। খাগড়াছড়ি ফিরে ওখানকার কিছু স্পট ঘুরে আজ বিকাল তিনটার মধ্যে আমাদের রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। চাপাই চাকমা জানালো দেরি করলে পাহাড়ি পথে রাঙামাটি যেতে সমস্যা হবে। সকাল দশটায় এখান থেকে আর্মি এস্কর্ট ছাড়ে। আমাদের তাদের সাথেই যেতে হবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বেরিয়ে পড়লাম। নাস্তা সেরে হোটেলে ফিরে সবাইকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললাম। মেয়েদের তৈরি হতে কিছুটা সময় বেশি লাগে, তাই আমি আর মাসুদ ভাই তাড়া দিচ্ছিলাম। সময়ের নিঁখুত হিসেব করেও বেলা সাড়ে ন’টার আগে আমরা বের হতে পারলাম না। তাই গাড়ির সিরিয়ালে অনেকটা পেছনে পড়ে গেলাম। যাই হোক, আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমরা সাজেক ভ্রমণ শেষে ফিরে চললাম পরবর্তী গন্তব্য খাগড়াছড়ির পথে। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমাদের গাড়ি যখন নামছিলো, প্রথমে কিছুটা ভয় ভয় লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা কেটে গেলো। মেয়েরা এবারও ভয় পাবার পরিবর্তে মজাই পাচ্ছিলো। খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে খুব দ্রুতবেগে নেমে আসছিলো গাড়ি। আমরা খুব শক্ত করে সামনের সিটের হ্যাণ্ডেল ধরে রাখছিলাম। রাস্তার দু’পাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চিরদিন আমার মনস্পটে আঁকা থাকবে। অনেকটা পথা আসার পর আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। বাবু জানালো- সামনে জ্যাম। এখানে আর্মিরা পালা করে গাড়ি ছাড়ে। কিছুক্ষণ সাজেক আসার গাড়ি ছাড়ে এবং কিছুক্ষণ যাওয়ার গাড়ি। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে আসা গাড়ির লম্বা লাইন। ক্রমাগত গাড়ি আসছে তো আসছেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে ছিলাম আমরা। তারপর আবার চলতে শুরু করলো। চাপাই মারমা সময় বাঁচানোর জন্য খুব দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিলো, তবে আমাদের খাগড়াছড়ি পৌঁছুতে প্রায় দুপুর দু’টো বেজে গেলো। হাতে সময় আর বেশি নেই। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। লাঞ্চ সেরে যতটা সম্ভব খাগড়াছড়িতে দেখার মত স্পট দেখে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। খাওয়া শেষ হতে বেলা আড়াইটা পার হয়ে গেলো। চাপাই মারমা জানালো- রাঙামাটি যেতে হলে আপনারা এখানকার একটি মাত্র স্পটে যেতে পারবেন। খাগড়াছড়ির বিখ্যাত সেই রিসাং ঝর্ণা দেখা হলো না আমাদের। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আলুটিলা পাহাড়ের গুহা দেখে সোজা রাঙামাটি চলে যাবো।
     
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আলুটিলা পাহাড়ের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে একটু সামনে এগিয়ে পর্যটকদের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তার পাশেই রেলিঙ দেয়া একটি গোলাকার পাকা চত্বর, যেখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের প্রায় সবটুকুই দেখা যায়। লোকমুখে শোনা যায় এটি খাগড়াছড়ির সবচেয়ে উঁচু পর্বতশ্রেনী। সন্ধ্যার পর এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের দৃশ্য দেখার মজাই আলাদা। আমর সবাই এই চত্ত্বরে কিছু ছবি তুললাম। যাই হোক আমরা আমাদের মূল গন্তব্য আলুটিলা গুহার দিকে এগিয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নামছি তো নামছিই। অসংখ্য ধাপ অতিক্রম করে আমরা পাহাড়ের পাদদেশ তথা গুহামুখের কাছে পৌঁছালাম। তবে গুহামুখে পৌঁছে বেশ হতাশই হলাম, কারণ আমরা কেউ গুহায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। ভেতরটা অন্ধকার, পিচ্ছিল এবং স্যাঁতসেঁতে। মাসুদ ভাই একবার চেষ্টা করে ফিরে এসে জানালো ভেতরে পানি আছে। তাছাড়া সাথে মহিলা ও বাচ্চারা থাকায় গুহায় প্রবেশের চিন্তা বাদ দিলাম।
 
                                        
                                                          মাসুদ ভাইয়ের আলুটিলা গুহায় প্রবেশের চেষ্টা
 
       আশপাশটা ঘুরে দেখে আমরা ফিরে চললাম। গুহায় নামতে গিয়ে সবাই যে রকম আনন্দ পেয়েছিলো উপরে উঠতে গিয়ে টের পেলো ওঠাটা কত কষ্টকর। সবাই মোটামোটি হাঁপিয়ে উঠলাম। প্রায় তিন’শর কাছাকাছি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। যাই হোক, কিছু সময় রেস্ট নিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। আমরা গাড়িতে উঠতেই চাপাই মারমা রাঙামাটির পথে চলতে শুরু করলো। খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলাম, চলতে গিয়ে তেমন মনে হচ্ছে না। রাস্তায় প্রচুর বাঁক আর উঁচুনিচু। পথ সমস্যার কারণ না হলেও বাঁক গুলোই ভোগাচ্ছে বেশি। গাড়িতে বসে থাকাই কষ্টকর। চাপাইকে বললাম একটু আস্তে চালাতে। কখনও সবুজ পাহাড় আবারর কখনও সমতল ভুমি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের ঢালে আনারসের চায হচ্ছে, কোথাও নতুন চারা লাগানো হচ্ছে। সেগুলো দেখে বাচ্চাদের নানা প্রশ্ন, উত্তর দিতে হচ্ছে। রাস্তা মোটামাটি নির্জনই বলা যায়। চাপাই মারমা সন্ধ্যার আগে রাঙামাটি পৌঁছুতে চায়, তাই গাড়ি বেশ দ্রুত চালাচ্ছিলো। পথে দু’জায়গায় আর্মি চেকিঙের জন্য গাড়ি থামালো। ড্রাইভারকে কিছু রুটিন প্রশ্ন করে ছেড়ে দিলো। সন্ধ্যা নামার কিছুটা আগেই আমরা রাঙামাটি পৌঁছে গেলাম।  

চলবে ......

ফিরে দেখাঃ
ভ্রমণকথাঃ বছর শেষে মেঘের দেশে (১ম পর্ব)

ছবি
সেকশনঃ অন্যান্য
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 06/01/2020
সর্বমোট 2981 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন