ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ভ্রমণকথাঃ বছর শেষে মেঘের দেশে (শেষ পর্ব)

রাঙামাটির পথে পথে, নীল জলে ভেসে...

আগেরবার যখন রাঙামাটি এসেছিলাম তখন আমার মেয়ে রিয়াসা অনেক ছোট। ওর স্মৃতিতে হয়তো তখনকার কোন ছবিই নেই। তাই ভাবলাম এবারের রাঙামাটি ভ্রমণ ওর জন্যও অনেক আনন্দদায়ক হবে। মাসুদ ভাইদের জন্য এটি নতুন জায়গা। রিয়াসা জিজ্ঞেস করলো- বাবা, এখানেও কি পাহাড়-মেঘ দেখা যাবে? আমি বললাম- পাহাড় দেখা যাবে তবে সাজেকের মত মেঘ দেখা যাবে না। লেক দেখতে পাবে, আমরা সবাই মিলে বোটে চড়ে ঘুরবো সেই লেকে। তোমরা ঝুলন্ত ব্রিজে উঠবে, বোটে করে সুবলং ঝর্ণার কাছে যাবে, তবে মনে হয় না ঝর্ণায় এখন পানি দেখতে পাবে। এতকিছু দেখতে পাবে শুনে ওরা বেশ খুশি।
যাই হোক, রাতে আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না। পর্যটনের মোটেলটা বেশ পছন্দসই ছিলো। আমার স্ত্রী এসব ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে, সেও পছন্দ করলো। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সামনে লম্বা করিডোর, পেছনে প্রশস্ত বারান্দা। হোটেলের পেছন দিকে কিছুটা খোলা জায়গা, সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য কয়েকটা রাইড বসানো আছে। মেয়েরা সেখানে দোলনায় বসে কিছুটা সময় কাটালো। তবে বারান্দার দরজায় বানরের বিষয়ে সতর্কবাণী দেখে ওরা আমাদের পাহারাদার হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখলো। সাজেকের তুলনায় এখানে শীত কিছুটা কম। আমি ও মাসুদ ভাই ঝুলন্ত ব্রিজের ওপারে গিয়ে পরেরদিন সকালে লেকে ভ্রমণের জন্য বোট ভাড়া করে আসলাম। সকালে বোটে করে রওনা দেবো, সারাদিন ধরে লেকের আশেপাশে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসবো এখানেই- এভাবেই বোট মালিকের সাথে কথা ফাইনাল হলো। আমরা পর্যটনের রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেলাম, তারপর রুমে ফিরে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে রাতের ঘুমটা চমৎকার হয়েছিলো।
খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত ভাললাগায় ছেয়ে গেলো মনটা। সবুজ গাছপালা ঘেরা নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারিদিকে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। সেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে পেছনের কাপ্তাই লেকের টলটলে নীল জল দেখা যাচ্ছিলো। একপাশ থেকে ঝুলন্ত ব্রিজের কিছুটা অংশও চোখে পড়ছিলো। আমি মেয়েকে ডেকে তুললাম। প্রথমে কম্বলের ওম ছেড়ে বের হতে চাচ্ছিলো না, তবে ঝুলন্ত ব্রিজের কথা শুনে উঠে পড়লো। মেয়েকে তুলে দিয়ে আমি গোসলে চলে গেলাম। গোসল সেরে বের হতেই দেখি গিন্নি বিছানা পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলেছে। আমি তৈরি হয়ে নিচে চলে গেলাম। মুমু-ইরা-রিয়াসা যথারীতি দোলনায় দোল খাচ্ছে আর লেকের টলটলে নীল জলের গুণগান করছে। আমি ওদের তাড়া দিয়ে বললাম- ওখানে যেতে হলে গোসল সেরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো। ওরা রুমে চলে গেলে আমি আর মাসুদ ভাই হোটেলের সামনে আদিবাসীদের তৈরি দ্রব্যের দোকানে গেলাম। এখানে স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রামে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি হয়। দামও তেমন বেশি নয়। আমরা ঠিক করলাম লেক থেকে ঘুরে এসে কিছু কেনাকাটা করবো।

                          
                                                                          ঝুলন্ত ব্রিজে ওঠার আগমুহূর্তে রিয়াসা

নাস্তা সেরেই আমরা ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে এগোলাম। ব্রিজের ওপার থেকে বোটে উঠবো। মেয়েরা ব্রিজে এবং তার আশেপাশে কিছুক্ষণ ছবি তুললো। অব্যবস্থাপনা এবং তত্ত্বাবধানের অভাবে ব্রিজটা আর আগের মত আকর্ষণীয় নেই। কাঠগুলো বেশ নড়বড়ে হয়ে আছে। যাই হোক, আমরা ব্রিজ পার হয়ে বোটে উঠে বসলাম। কিচ্ছুণের মধ্যেই আমাদের প্রমোদ তরী লেকের জল কেটে চলতে শুরু করলো। লেকের শান্ত জলের উপর দিয়ে আমরা ভেসে চলছিলাম তবে নৌকার ইঞ্জিনের ভটভট শব্দটা পরিবেশের সাথে বেমানান লাগছিলো। মাঝে মাঝে বিরক্তিকরও। ইঞ্জিনের শব্দে আমরা নিজেদের কথাই ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলাম না। আহা! এমন চমৎকার পরিবেশে এই শব্দটা যদি না থাকতো! মাসুদ ভাইয়ের আক্ষেপের উত্তরে আমি হাসতে হাসতে বললাম- এই ইঞ্জিঞ্চালিত বোটে করে সুবলং ঝর্ণার কাছে যেতে এবং ফিরে আসতেই তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে, আর বৈঠা চালিত নৌকায় গেলে তো আজ আর ফেরা হতো না। তাছাড়া আমাদের আরও কয়েকটি স্পটে যেতে হবে। আমরা এগিয়ে চলছিলাম নীল জলে ভেসে ভেসে আর চারপাশে দেখছিলাম সবুজ পাহাড়ের সারি; দুরে-কাছে, উঁচুনিচু। কোথাও ঝাপসাভাবে পাহাড়ের অবয়ব চোখে পড়ছে অনেক দূরে। আবার থেকে থেকেই লেকের জলরাশির মাঝে দ্বীপের সদৃশ ছোট ছোট পাহাড় চোখে পড়ছিলো। মোটকথা এমন চমৎকার পরিবেশে সারাদিন অনায়াসেই পার করে দেয়া যায়। আমাদের বোট চালকের নাম মিল্টন। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- এখানে কোথাও একটা পুরনো রাজবাড়ী ছিলো, আমরা কি ওখানে যাবো? ও জানালো- রাজবাড়িটা এখন আর নেই, ওটা পানির নিচে চলে গেছে। আমার মনে পড়ছিলো আগেরবার আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। তখন ওখানে পুড়ে যাওয়া কিছু ঘর দেখেছিলাম। আমি আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম- আর ‘রাজবন বিহার’? উত্তরে মিল্টন বলল- ওখানে তো শহর থেকেও যাওয়া যায়, তাছাড়া ওখানে বাঙালিরা আর তেমন যায় না। আমি জানতে চাইলাম- কেন? ও জানালো- রাজবন বিহারে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের আনাগোনার ফলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপাসনা ও ভান্তেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়, তাই পর্যটকদের জন্য রাজবন বিহারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি বললাম- ও আচ্ছা! আমাদের তাহলে রাজবন বিহারে যাওয়া হচ্ছে না!

                           
                                                                                                               কাপ্তাই লেক

কাপ্তাই লেকে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে মেয়েরা খুব খুশি ছিলো। হঠাৎ আমি ওদের আনন্দে ব্যঘাত ঘটালাম। জিজ্ঞেস করলাম- এই কাপ্তাই লেক কীভাবে তৈরি হয়েছে জানো? আজ আমরা এই নীল জল দেখে আনন্দিত হচ্ছি, অথচ জানো এই জলের নিচে জমে আছে কত মানুষের কান্না? ওরা সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কেন?  
কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে আমি যতটুকু শুনেছি তাই ওদের বললাম। ওরা খুব মনোযোগী শ্রোতার মতই শুনছিলো। আমি বললাম- তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়। এই বাঁধের কারণে এই অঞ্চলের চুয়ান্ন হাজার একর কৃষিজমি ডুবে যায় যা এখানকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। সেই সাথে প্রায় আড়াই’শ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়। এই এলাকায় বেশির ভাগই ছিলো চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের এক লাখের মত মানুষ তাদের বসতবাড়ি আর কৃষিজমি হারিয়েছিল। তাই বলা হয়- কাপ্তাই লেকের নীল জলে মিশে আছে এখানকার আদিবাসিদের কান্না।
আমার কথা বলা শেষে দেখলাম ওদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। পরিবেশটা হালকা করতেই বললাম- তোমাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। বৃহত্তর স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রেই কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই স্থানকেই হয়তো তৎকালীন বিশ্লেষকরা উপযোগী মনে করেছিলো। এটা বিশ্বের সব দেশেই হয়ে থাকে। নদীতে বাঁধ নির্মান, ব্রিজ তৈরি কিংবা রাস্তা তৈরির জন্য অনেক মানুষের ঘরবাড়ি সরকার চাইলেই নিয়ে নিতে পারে। এই যেমন পদ্মা সেতুর জন্য অনেক মানুষের বাড়ি-ঘর, চাষের জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে। যাদের কাগজপত্র ছিলো- তারা এই জমির পরিবর্তে টাকাও পেয়েছে। মন খারাপ না করে তোমরা মজা করো।

আমাদের এখনকার গন্তব্য সুবলং ঝর্ণা, ওটাই সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। আমরা সেদিকেই ছুটে চলছিলাম। ঝর্ণা দেখে বাকী স্পটগুলো দেখতে দেখতে ফিরে আসবো আবার সেই ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে। চারিপাশের দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছিলো। কোথাও টিলাসদৃশ ছোট ছোট পাহাড়, কোথাওবা উঁচু। পাহাড়ের পাড়গুলো অনেকটা পাথরের মত শক্ত। লেকে জেলেনৌকা খুব একটা দেখা যাচ্ছিলো না। দু’একটা নৌকা চোখে পড়ছিলো এই দীর্ঘসময় ধরে। আমি বিভিন্ন এঙ্গেলে লেকের ছবি তুলছিলাম। মেয়েদেরও দেখলাম মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কখনও নিজেদের আবার কখনওবা লেকের দৃশ্য। এভাবে চলতে চলতেই আমরা পৌঁছে গেলাম সুবলং ঝর্ণার কাছে। জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। চারিদিকে অনেকগুলো উঁচু পাহাড়, তার মধ্যে দিয়ে একটা সরু চ্যানেল বেরিয়ে গেছে অন্য প্রান্তে। সেখান দিয়ে ছোট বড় নৌকা ছুটে চলছে। আমরা সবাই ঝর্ণার স্পটে নামলাম। তবে সবচেয়ে হতাশার কথা হলো- এবারও ঝর্ণায় পানি নেই। আগেরবারও যেমন দেখতে পাইনি। আমরা সবাই ওখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কিছুটা সময় কাটিয়ে সুবলং ত্যাগ করলাম।

                           

                                                                                কাপ্তাই লেক- সুবলং ঝর্ণার সামনে থেকে

আমরা ফিরে চলেছি সেই একই পথ ধরে, অর্থাৎ লেকের যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। এখান থেকে অল্প কিছুদূর এগোলেই একটি আদিবাসিদের গাঁ রয়েছে। এখানে গাঁ বলতেও সেই পাহাড়। পাহাড়ের কোলঘেঁষে ভিড়লো আমাদের বোট। আমরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম পাহাড়ের উপরে। লেক থেকে পাহাড়ের উচ্চতা কম-বেশি এক’শ ফুটের মত হবে। আমার কাছে সেই পাহাড়ি গাঁয়ের আলাদা কোন বিশেষত্ব চোখে পড়েনি। কয়েকটি টিনের ঘর, সবজী মাচা ও বিভিন্ন ফলমূলের গাছগাছালি আর আদিবাসী মানুষজন। তবে সেখানে কয়েকটি দোকান ছিলো, আদিবাসিদের হাতে বোনা কাপড়চোপড়, শাল, ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিলো। আমরা সেখান থেকে কিছু কেনাকাটা করে নেমে পড়লাম।
আবার চলতে শুরু করেছে আমাদের নৌকা। এবারের গন্তব্য- রেস্টুরেন্ট। কাপ্তাই লেকে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। লেকে ভ্রমণরত পর্যটকদের একটা বড় অংশ এসব রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবার খেয়ে থাকে। এমনই দু’টো রেস্টুরেন্ট পেদা টিং টিং অথবা চাংপাং। এর যে কোন একটিতে আমরা দুপুরের খাবার খাবো। ‘আর যাই হোক- ব্যাম্বু-চিকেন আমি খাবো না’ মাসুদ ভাইয়ের বলার স্টাইলে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম- ‘ঠিক আছে আপনি ব্যাম্বু-ফিশ খাইয়েন’ মাথা নেড়ে সে বলল- ‘দরকার নাই আমার ব্যাম্বু-ফিশ চিকেনের। তবে বাঁশকোড়ল দিয়ে চিংড়ি খাওয়া যেতে পারে, না পেলে আমার জন্য ডাল-আলু ভর্তাই যথেষ্ট’। এমনি হাসি আনন্দে আমাদের সমটা কেটে যাচ্ছিলো। চাংপাং এর কাছে পৌঁছুতেই নৌকা ভিড়ালাম। চলেন এখানেই খাই। মনে পড়লো- ন’বছর আগে আমরা এখানেই খেয়েছিলাম। মাসুদ ভাইয়ের জন্য দুঃসংবাদ; ডাল-আলুভর্তা পাওয়া যায়নি। তাই আমরা মুরগী আর রুই মাছ অর্ডার করলাম। আমাদের আধা ঘণ্টা বসিয়ে রেখে রাধুনি রান্না করলো, তারপর যা খাওয়ালো তাতে আমাদের মুরগী খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। সে খাবার কোনরকম গলদকরণ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
আরও কিছুদূর এগিয়েই দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপরে একটি বৌদ্ধমূর্তি। আমাদের বোটম্যান মিল্টন পাহাড়ের পাদদেশে নৌকা ভিড়ালো। মাসুদ ভাই আর মহিলারা বোটেই রয়ে গেলেন, বাচ্চাদের নিয়ে আমি নেমে পড়লাম। ওদের নিয়ে কিছুদূর উঠলাম। তবে মেয়েদের নিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে বেশি উপরে ওঠা বিপদজনক হতে পারে ভেবে আর উঠলাম না। পাহাড়ের শুরুতে, লেক থেকে কিছুটা উচ্চতায় একটি ছোট বাজার রয়েছে। এখানেও আদিবাসিদের হাতে বোনা কাপড়চোপড় অন্য অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। আমরা নেমে আসতেই দেখি মাসুদ ভাই ডাব নিয়ে বসে আছে। সবাই সেই ডাবের সুমিষ্ট পানি খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। ঝুলন্ত ব্রিজের কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে পলওয়েল পার্ক। লেক সংলগ্ন একটি বিনোদন কেন্দ্র। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের নৌকা পলওয়েল পার্কের পাশে এসে নোঙর করলো। পাড়ে নেমে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ডিসি বাংলো রোডে গড়ে তোলা পলওয়েল পার্কটি রাঙামাটির পর্যটকদের জন্য বিনোদনের একটি নতুন সংযোজন। আগেরবার যখন রাঙামাটি এসেছিলাম, তখন এই পার্কটি ছিলো না। যাই হোক, এখানে রয়েছে শিশুদের জন্য একটি কিডস জোন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরবার জন্য কিছু ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। পায়ে চলা রাস্তার পাশে লেকের পাড় ঘেঁষে পর্যটকদের বসার জন্য রাখা আছে কিছু বিচ চেয়ার, এখানে বসে পর্যটকরা লেক আর পাহাড়ে সন্ধ্যা নামার দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। দেখতে পারে লেকের টলটলে নীল জল; কাছে-দূরে সারি সারি সবুজ পাহাড় আর আকাশের নিবিড় মিতালী। এছাড়া পার্কটিতে রয়েছে পলওয়েল কটেজ ও সুইমিং পুল। আরও রয়েছে পুনাক কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র; যেখানে স্যুভেনির, আদিবাসীদের হাতে বোনা কাপড়চোপড় পাওয়া যায়। মেয়েরা কিডস জোনে খেলায় মেতে উঠলো। আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম। পার্কটির একেবারে শেষ প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে একটি ‘লাভ পয়েন্ট’। এই ভালোবাসার স্মারকটি তৈরির পেছনে একটি মর্মান্তিক গল্প আছে। ২০১৪ সালের ২৯শে মার্চ কাপ্তাই লেকে বোট উল্টে মৃত্যু হয় আমেরিকা প্রবাসী দম্পত্তি আলাউদ্দিন ও তার স্ত্রী আইরিন লিমা’র। তিনদিন পর কাপ্তাই লেক থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সম্মিলিত অভিযানে উদ্ধারকৃত এই দম্পত্তির মৃতদেহ দুটিকে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় লেকে পাওয়া যায়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা একটি বিরল ঘটনা। তাদের এই ভালোবাসাসহ পৃথিবীর সকল মানুষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উনয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নির্মাণ করা এই ‘লাভ পয়েন্ট’। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে আমরা পলওয়েল পার্ক থেকে নেমে আসলাম। আবার আমাদের বোট ছুটে চলেছে নীল লেকের জল কেটে। তার কিছুক্ষণ পরই পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য তার বিদায় বার্তা জানান দিলো। পশ্চিম দিগন্তে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে লেকের জলে। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। দিনের এই বিশেষ সময়টার প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে। আর নৌকায় বসে এমন দৃশ্য দেখা সত্যিই এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গিয়ে চারিদকে আঁধার নেমে আসলো, আর আমরাও পৌঁছে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে। এখানেই আমাদের লেক ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটলো।  

রাতে মোটামোটি বিশ্রাম নিয়েই সময়টা কাটালাম। মহিলারা হোটেলের পাশের বিক্রয়কেন্দ্রে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলো। তারপর রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে চলে গেলাম। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসলাম। রিসেপশনের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম আর কোথায় যাওয়া যায়। ও জানালো ক্যান্টমমেন্টের কাছে আছে আরণ্যক রিসোর্ট, ওখানে যেতে পারেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওখানে কি কি আছে? ও জানালো- ওটা একটা পার্কের মত। সুইমিং পুল, বোটে ভ্রমণ, বাচ্চাদের জন্য কিছু রাইড আছে। আর কোথাও যাওয়ার আছে? রাজবন বিহারে যেতে পারেন, ছেলেটা বললো। ওখানে তো আমাদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ, তো ওখানে গিয়ে লাভ কি? ছেলেটা হেসে সায় জানালো। রুমে ফিরে সবাইকে জানালাম। মেয়েরা আরণ্যক রিসোর্টে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না। তো কোথাও গিয়ে কাজ নেই। কিছু কেনেকাটা থাকলে টেক্সটাইল মার্কেটে চলো। সবাই তৈরি হয়ে নাস্তা সেরে মার্কেটের দিকে চললাম। আবার সেই স্থানীয় আদিবাসিদের তৈরি কাপড়চোপড় কেনা হলো, তবে এখানে দাম অন্য জায়গা থেকে কম।
দুপুরের খাবার পর কিছু সময় রেষ্ট নিয়ে নিলাম। আমাদের গাড়ি ছাড়বে রাত সাড়ে আটটায়। হাতে অনেক সময়। ঝুলন্ত ব্রিজের ওপারে আদিবাসিদের একটা গাঁ আছে। গতকাল বোটে চড়ার সময় দেখেছিলাম, যাওয়া হয়নি। এখন সেখানে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই পাহাড় বেয়ে নামা এবং ব্রিজের ওপারে গিয়ে উপরে ওঠা। আমাদের নামতে উঠতে কিছুটা সময় লাগলেও মেয়েরা খুব দ্রুত উঠে যাচ্ছিলো। পাহাড়ের উপরে উঠেই দেখলাম একটা বাজারের মত। আদিবাসী নারীপুরুষ তাদের নিজস্ব বাগানো ফলানো নানান ধরণের ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসেছে। আনারস, পেঁপে, কলা, বড়ই, তেঁতুল, ডাব ও বিভিন্ন ধরণের সবজী। কেউ কেউ বাহারি স্যুভেনির ও হস্তশিল্পদ্রব্য নিয়ে বসেছিলো। এদের মধ্যে অবশ্য পাহাড়ি আদিবাসিদের সাথে বিভিন্ন বয়সী বাঙালিদেরও দেখা যাচ্ছিলো। আরও কিছুদূর এগিয়ে আবার কিছু কাপড়চোপড়ের দোকান। তার পাশ দিয়ে গ্রামে ঢোকার রাস্তা চলে গেছে। আমরা গ্রামের কিছু অংশ ঘুরে দেখলাম। খুব সাধারণ জীবনযাপন। তবে এখানে বাঙালি-আদিবাসী উভয়ের বসবাসই চোখে পড়লো। আমরা আরও কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসলাম হোটেলে।
টুকটাক গোছগাছ যা বাকি ছিল সম্পন্ন করে রাখলাম। রিসেপশনে গাড়ির জন্য বলে রেখেছিলাম। সাড়ে সাতটার দিকে আমাদের গাড়ি এসে হাজির। আমরা হোটেল থেকে বিদায় নিলাম। রাঙামাটি শহরে কোন রিক্সা নেই, তাই ট্রাফিক জ্যামও নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছে গেলাম। যাত্রার আগে কেউ কিছু খেতে চাইছিলো না, তাই রাতের জন্য কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নিলাম। নির্ধারিত সময়ে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমরা ফিরে চললাম আমদের নীড়ে।
চীনা লেখক লিন ইউভাং বলেছেন- ভ্রমণ শেষে নিজ বাড়িতে ফেরার আগ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারে না ভ্রমণ কত সুন্দর ছিলো। তবে আমি ভ্রমণের সময়কালীন প্রতিটা মুহূর্তই উপভোগ করেছি। সবুজ পাহাড়, সফেদ-শুভ্র মেঘ, নীল জলের কাপ্তাই লেক, আদিবাসিদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন- সবকিছুই। আর আমাদের মেয়েরাও দারুণভাবে উপভোগ সেই খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক গমণ থেকে শুরু করে কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ- পুরো সময়। আমার কাছে এটাই এই ভ্রমণের সার্থকতা।


ফিরে দেখাঃ
ভ্রমণকথাঃ বছর শেষে মেঘের দেশে (১ম পর্ব)
ভ্রমণকথাঃ বছর শেষে মেঘের দেশে (২য় পর্ব)
 

ছবি
সেকশনঃ অন্যান্য
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 27/01/2020
সর্বমোট 1394 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন