এরা কি মরবে না? এদের কি মৃত্যুভয় নেই!
সাইয়িদ রফিকুল হক
মানুষমাত্রেই মরণশীল। জন্মিলে মরিতে হয়। একথা আমরা সবাই জানি। তবুও যেন কারও-কারও বিশ্বাস হতে চায় না! মানুষ যদি মনেপ্রাণে জানতো-মানতো আর বিশ্বাস করতো যে, সে যেকোনো সময় মারা যাবে―তাহলে, পৃথিবীতে আজ এত পাপ আর এত তাপ থাকতো না। পৃথিবী তখন হয়ে উঠতো সত্যিকারের একটা জান্নাত! আর তখন পৃথিবীতে বহমান থাকতো শুধু দখিনা বাতাস। বিরাজ করতো নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া! পৃথিবীজুড়ে কায়েম হতো কবিতার মতো স্নিগ্ধ ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ! মানুষের দুঃখ বলে কোনোকিছু থাকতো না। কিন্তু মানুষের এই বোধ নাই বলেই পৃথিবীটা আজ ক্রমশ যেন জাহান্নাম হয়ে উঠছে! আর এই জাহান্নাম বানানোর পিছনে রয়েছে একদল, একজাতীয় ও একশ্রেণীর নীতিহীন, অতীব মূর্খ ও অর্বাচীন। সবকিছুতে এদের বাড়াবাড়ির কারণেই আজ পৃথিবীটা এত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে!
মানুষ মারা গেলে―মানুষের মৃত্যুসংবাদ শুনলে―মানুষ মর্মাহত হয়। আফসোস করে। বেদনাহত হয়। মানুষের মনে কষ্ট লাগে। মানুষের কান্না পায়। আর সে দুনিয়ার যেকোনোস্থানের যেকোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষ হোক না কেন―তার মৃত্যুর খবর শুনে মানুষের কান্না পায়। এটাই স্বাভাবিক। তার কারণ, মানুষ মানুষের প্রতি দয়াপরবশ, সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল। মানুষের প্রতি মানুষের রয়েছে মমত্ববোধ। এটি সহজাতপ্রবৃত্তি। আর যাদের স্বভাবে এগুলো নাই―তারা কখনো মানুষ নয়।
রক্তমাংসের দেহধারী মানুষের একটা মন রয়েছে। আত্মা রয়েছে। মানুষের একটা হৃদয়ও আছে। আর মানুষের হৃদয়ের সৃষ্টি হয়েছে ভালোবাসার জন্য। মহামতি অ্যারিস্টটল এইজন্য যথার্থই বলেছেন: এই পৃথিবীর ফাউন্ডেশন হচ্ছে ভালোবাসা।
মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। নইলে, পৃথিবীর ফাউন্ডেশন যে নড়বড়ে হয়ে যাবে। আদতে আজ হচ্ছেও তা-ই।
একজন মুসলমানের মৃত্যুসংবাদ শোনার সঙ্গে-সঙ্গে সর্বস্তরের মুমীন-মুসলমানকে অবশ্যই ভক্তি ও বিশ্বাসসহকারে পড়তে হবে: ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এটি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত। এটি একটি দোয়াও বটে। এটি পাঠ করে মৃত মানুষের জন্য মঙ্গলকামনা করতে হয়। এর অর্থ হলো―“নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য, এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।” সকল মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি পড়তে হবে। আর এক্ষেত্রে, কোনোভাবেই শত্রুমিত্র বিবেচনা করা যাবে না। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে: “মুমীন পরস্পর ভাই ভাই। আর মুসলমান ভাই ভাই।”
কিন্তু আমরা সমাজে এখন কী দেখছি? একশ্রেণীর অর্বাচীন আজ মৃতব্যক্তিকেও সমানে গালিগালাজ করছে! তাও শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায়! আর তার মৃত্যুতে ভয়ানকভাবে আনন্দিত ও উল্লাসী হয়ে উঠছে! এসব আলামত কখনোই ভালো নয়। শত্রুর মৃত্যুতেও উল্লসিত হয়ে উঠার কোনো কারণ ও সুযোগ নাই। আমরা সবাই মানুষ। আমরা আদমের সন্তান। আর আদম আ. সৃষ্টি হয়েছেন মাটি থেকে। আমরা মাটির সন্তান। মাটিতেই একদিন মিশে যাবো। তাই, আমাদের এত অহংকারী হয়ে উঠার কোনো অধিকার নাই।
সম্প্রতি দেওয়ানবাগী-হুজুরের মৃত্যু হয়েছে। ৭০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। একদিন সবাইকে মরতে হবে। চাইলেও আর না-চাইলেও মরতেই হবে। এক্ষেত্রে কারও কোনো ছাড় নাই।
তিনি একজন পীর ছিলেন। অনেকের কাছে তিনি পীর, মুরশিদ বা কামেল সাধক। আবার কারও-কারও কাছে তিনি শুধুই ভণ্ড বা প্রতারক! তাঁর ভালোমন্দ নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাইছি না। আমি তাঁর ভালোমন্দ বলার কে? তিনি কেমন ছিলেন, সেটি বিচার করবেন মহান আল্লাহ। তবে তিনি যদি সামাজিক ও রাষ্ট্রিকভাবে কোনো অপরাধী হতেন বা হয়ে থাকেন―তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি জীবিত থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাদায়ের করা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসদমন-আইনেও তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো মামলাদায়ের করা হয়নি। এখন তিনি মৃত! তবুও তাঁর বিরুদ্ধে একশ্রেণীর মানুষ কী কুরুচিপূর্ণ আর জঘন্য ভাষায় বিষোদগারে ও গীবতে লিপ্ত হয়েছে!
তিনি একজন মুসলমান ছিলেন। আর একজন মুসলমান হিসাবে তাঁর ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি কখনো জঙ্গি নন। স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না। ধর্মের নামে রাজনীতিও করতেন না। অবশ্য ধর্মবিষয়ে নানান কথা বলতেন। এক্ষেত্রেও তাঁর ভুলত্রুটি হতেই পারে। তবুও তিনি একজন মুসলমান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে কিছুসংখ্যক অমানুষ ফেসবুকে ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতটাই উল্লাসী আর হিংস্র হয়ে উঠেছে, তা দেখে আমি, আর আমার মতো অনেকেই এতটা বিস্মিত যে, তা আজ আর ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সেই দৃশ্য দেখেই মদীয় লেখাটি প্রকাশিত হলো। এটি শুধু একজন দেওয়ানবাগী-হুজুরের জন্য নয়, সকল মৃত মানুষের কথা ভেবে রচিত হয়েছে।
কেউ-কেউ মৃত দেওয়ানবাগী-হুজুরকে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করেছে। কেউবা এতে আনন্দপ্রকাশ করে নিজ-নিজ ফেসবুকে বা সামাজিক সাইটে পোস্ট করেছে নানারকম কথাবার্তার ফুলঝুরি! তারা যা বলেছে, তা কখনোই মুদ্রণযোগ্য নয়। তাদের এসব উপহাস, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, ইয়ার্কি-ফাজলামি আর রসিকতা এতটাই অশ্লীল যে, তা এখানে তুলে ধরাও সম্ভব নয়। কিন্তু কাজটি কি তারা ভালো করেছে? আসুন, এইব্যাপারে আমাদের―মানে, মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন ও আল-হাদিস কী বলে তা জেনে নিই।
আগেই বলেছি: মানুষকে মরতেই হবে। কেউ পৃথিবীতে চিরস্থায়ী নয়। এ-প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন―
“আপনার আগেও কোনো মানুষকে আমি অনন্ত জীবনদান করিনি। সুতরাং, আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরঞ্জীব হবে? প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ-আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৩৪-৩৫)
“প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলাপ্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে, এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়।” (সুরা আলে-ইমরান: আয়াত ১৮৫)
মহান আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র বলেন, “আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা, এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবেন উত্তমপন্থায়।”(সূরা নহল, আয়াত: ১২৫)
এখানে, মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানুষের কাছে ‘হিকমত ও সদুপদেশে’র মাধ্যমে দাওয়াত দিতে বলেছেন। এবং তাদের সঙ্গে সুন্দর-ভাষায় তর্কবিতর্ক করতে বলেছেন। এসব বিবেচনা করলে আমরা সাধারণ মানুষ তাহলে কী? আর কীসের এত অহংকার আমাদের?
এ-প্রসঙ্গে হজরত ফুজাইল (র.) বলেন, “ঈমানদার লোক দোষ গোপন রাখে ও একান্তে উপদেশ দেয়। আর পাপী লোক মানুষকে অসম্মান করে, ভর্ৎসনা করে ও প্রকাশ্যে লজ্জা দেয়।” (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ২৩৬)
কারও সম্পর্কে অনুমান করে খারাপ ধারণাপোষণ করা যাবে না। আর এ-প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা অনুমান হতে বেঁচে থাকো, নিশ্চয়ই ধারণা করা অনেক ক্ষেত্রেই পাপ; আর তোমরা অন্যের গোপন বিষয় সন্ধান কোরো না, এবং পরের পশ্চাতে (পিছনে) নিন্দা কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তা ঘৃণাই করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ তওবাগ্রহণকারী, পরম দয়ালু।”(সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মৃত ব্যক্তিদের গালমন্দ কোরো না। কারণ, তারা যা করেছে তার প্রতিফল পাওয়ার স্থানে পৌঁছে গেছে।” (বুখারি শরীফ)
অন্য এক হাদিসে পাওয়া যায়: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না। এতে মৃতব্যক্তির আত্মীয়রা কষ্ট পায়।” (তিরমিযী শরীফ)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “তোমরা, তোমাদের মৃতদের ভালো কাজগুলোর আলোচনা করো, এবং মন্দ কাজের আলোচনা থেকে বিরত থাকো।” (সুনানে আবু দাউদ শরীফ)
আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত ব্যক্তিদের গালমন্দ করাটাকে কখনো পছন্দ করতেন না। তিনি এই ঘৃণ্যপ্রথার অবসানও ঘটান। হজরত যুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে (অজ্ঞাতসারে) আগেকার জাতিসমূহের রোগ, অর্থাৎ হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা সংক্রমিত হয়ে গেছে। এসব রোগ ন্যাড়া করে দেয়। আমার কথার অর্থ এই নয় যে, তা চুল ন্যাড়া করে দেয়, বরং দীনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।” (মুসনাদে আহমদ)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাক। কেননা হিংসা মানুষের ভালো গুণসমূহ এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। (আবু দাউদ শরীফ)
অন্যের দোষত্রুটি গোপন রাখা একজন মুমিনের অবশ্য কর্তব্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে বান্দা অন্য বান্দার দোষত্রুটি এই পার্থিব জীবনে গোপন রাখবে, আল্লাহতা’আলা কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন।”(মুসলিম শরীফ)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেন, “আমার সব উম্মতের গুনাহ মাফ হবে। কিন্তু দোষত্রুটি প্রকাশকারীর গুনাহ মাফ হবে না।”
হজরত আবু আইউব আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “কোনো ব্যক্তির জন্য তার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে তিনদিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকা হালাল নয়। অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, দুজন মুখোমুখি হলে একজন এদিকে এবং অপরজন ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। দুজনের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যে প্রথমে সালাম দিয়ে কথাবার্তা শুরু করে।” (বুখারি ও মুসলিম শরীফ)
অপর এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন, 'আল বাদিউ বিস-সালাম বারিউম-মিনাল কিবরে'। অর্থাৎ, প্রথমে সালাম উচ্চারণকারী অহঙ্কার থেকে মুক্ত।
উপরিউক্ত হাদিস দুটিতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্যসৃষ্টির সম্পর্ককেই ইসলাম সবসময় গুরুত্ব দেয়। মৃত বা জীবিত কারও প্রতি ঘৃণাবিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা রাখা বা পোষণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে সবসময় পরিত্যাজ্য। এটা কখনো জায়েজ হতে পারে না। অথচ, আমরা আজকাল কথায়-কথায়, রসিকতা করে বা ঠাট্টাচ্ছলে, কিংবা ক্রোধবশত মানুষকে অহেতুক গালমন্দ করছি। কিন্তু এর পরিণাম হয়তো আমরা জানি না! বুঝতে পারি না। বিশ্বাসও করতে পারি না!
হাদিসের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের কতকগুলো হক বা অধিকার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
কেউ মারা গেলে তার জানাজায় উপস্থিত হওয়া। এখানে, কারও সঙ্গে কারও শত্রুতা থাকলেও বিভেদ ভুলে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মৃতব্যক্তির আত্মার মাগফিরাতের জন্য দু’আ করা। মৃতব্যাক্তির পরিবারপরিজনকে সান্ত্বনা দেওয়া। ঋণগ্রস্ত হলে তার ঋণমওকুফের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। কিন্তু আমরা এসবকিছু ভুলে, ছেড়ে দিয়ে, জিদের বশবর্তী হয়ে আজকাল এটা কী করছি!
হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট দিয়ে একটি জানাজা গেল। অতঃপর তার উত্তম প্রশংসা করা হলো, উত্তম প্রশংসা মুখে-মুখে হতে থাকলো। তারা বললো, ‘আমাদের জানামতে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসতো।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘অপরিহার্য হয়ে গেল। অপরিহার্য হয়ে গেল। অপরিহার্য হয়ে গেল।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট দিয়ে আর-একটি জানাজা নিয়ে যাওয়া হলো, ওই জানাজায় নিন্দাজ্ঞাপন করা হলো (ওই জানাজার নিন্দা মুখে-মুখে লেগে থাকলো)। তারা বললো, ‘লোকটি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কতই-না খারাপ ছিল!’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘অপরিহার্য হয়ে গেল। অপরিহার্য হয়ে গেল। অপরিহার্য হয়ে গেল।’ হজরত উমর (রা.) বললেন, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। একটি জানাজার প্রশংসা করায় আপনি তিনবার অপরিহার্য হয়ে গেল বললেন। অপর জানাজায় নিন্দাজ্ঞাপনেও আপনি তিনবার অপরিহার্য হয়ে গেল বললেন?
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যার উত্তম প্রশংসা করলে তার জান্নাত অপরিহার্য হয়ে গেল ও তোমরা যার নিন্দা করলে তার জন্য জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে গেল। আর তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী, তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী, তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী। (মুসলিম)
মৃতমানুষকে গালমন্দ করলে তার যেমন খারাপ হতে পারে আমাদেরও খারাপ হতে বাধ্য। এতে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) অসন্তুষ্ট হন। এসব আমরা কবে বুঝবো?
আজকের দিনে মানুষকে আঘাত করাটা কত সহজ! এখনকার দিনের সোশ্যাল-মিডিয়ার জোরে মানুষ কত সহজেই একে অপরকে আঘাত করছে! কিন্তু এতে লাভ কী? পৃথিবীতে কেউ থাকবে না। সবাই আমরা মুসাফিরের বেশে রয়েছি। ডাক এলেই ছুটে যেতে হবে। এই পৃথিবীর কোনোকিছুই আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবো না। ইচ্ছা করলেও একটা টাকাও সঙ্গে নিতে পারবো না। সবকিছু ফেলে রেখে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে। শুধু আমাদের আমলগুলো চিরদিনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।
সোশ্যাল-মিডিয়ায় খুব সহজে কথা বলার ও লেখার সুযোগ রয়েছে সব মানুষের। এর সঠিক ব্যবহার করে আমরা মানুষ আর মানবতার পক্ষেও কাজ করতে পারি। মানুষকে ভালোবাসার কথাও বলতে পারি। ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করতে পারি। আবার এর অপব্যবহারের দ্বারা নানাবিধ অন্যায় কাজও করতে পারি। আমাদের প্রত্যেকের হাতে এখন অনেক ক্ষমতা! কিন্তু দুদিনের এই পৃথিবীতে মানুষকে এত ক্ষমতা দেখিয়ে আর ক্রোধান্বিত হয়ে আঘাত করে লাভ কী?
আজকাল প্রতিনিয়ত দেখছি, একশ্রেণীর মানুষরূপী ব্যক্তি ধর্মীয় মতভেদ, রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে ও সামাজিক নানারকম দ্বন্দ্বসংঘাতের জের ধরে মানুষের মৃত্যুতে যারপরনাই উল্লসিত হয়ে ফেসবুকের মতো দ্রুতগামী সোশ্যাল-মিডিয়ায় কতরকম আজেবাজে, আলতুফালতু ও নেতিবাচক মন্তব্য লিখে দ্রুত পোস্ট করছে! মানুষের মৃত্যুতে এভাবে উল্লসিত হওয়ার কারণ কী? একদিন আমাদেরও মৃত্যু হবে! আজ তুমি যে-লোকটির মৃত্যুতে এত উল্লসিত! তারচেয়ে করুণ মৃত্যু তোমারও হতে পারে। তবুও এদের নগ্নউল্লাস থামবে না? এদের অমানুষিক ব্যবহারে মনটা ভারী হয়ে ওঠে। আর মনে তখন বিরাট একটা প্রশ্ন জাগে: এরা কি মরবে না?
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক, সহজ ও সুন্দর পথে রাখুন। আমীন। আল্লাহহুম্মা আমীন। ছুম্মা আমীন।
সাইয়িদ রফিকুল হক
২৯/১২/২০২০