ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ দুঃসময়ের সারথি - পর্ব-১৭

অ-নে-ক দিন পর আবার সিরিজটার নতুন পর্ব পোষ্ট দিচ্ছি। আরও কয়েকজন বিদেশী বন্ধুকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক কতটুকু করা যায়। সত্যি বলতে কি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের লিস্টটা বেশ লম্বা। তবে তথ্যের অভাবে অনেকের সম্পর্কে লিখতে পারছি না। যখন যতটুকু তথ্য পাচ্ছি, মূল লেখার সাথে যুক্ত করছি। সেই প্রচেষ্টা হিসেবে আজ দু’জন (অস্ট্রেলিয়ার অবশ্য বেশ কয়েকজন) সম্পর্কে লিখছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
 
 
পিয়েরে ট্রুডো, কানাডা
                                              
 
      একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বিদেশী বন্ধুই বিভিন্নভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন। এ তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। অকৃত্রিম এ বন্ধুদের তালিকায়ই একজন ছিলেন কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। পুরো নাম জোসেফ ফিলিপ পিয়েরে ইভস ইলিয়ট ট্রুডো। কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডোর জন্ম ১৯১৯ সালের ১৮ অক্টোবর, কানাডার মন্ট্রিয়লে। ট্রুডো আইনের উপর ডিগ্রি নিয়েছেন মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়া অধ্যায়ন করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্যারিসের পলিটিক্যাল সায়েন্স ইন্সটিটিউটে এবং লন্ডনের স্কুল অব ইকনোমিক্সে। তিনি ষাটের দশকের শুরুতে মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে লিবারেল দলে যোগ দেন এবং মন্ট্রিয়ল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পিয়েরে ট্রুডো ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারপর কিছুদিন বিরোধী দলে থেকে আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচতি হন। বর্তমানে পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে জাস্টিন ট্রুডোও কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।
       একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব এনেছিলেন পিয়েরে ট্রুডো। যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ়ভাবে কথা বলেছেন এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের শিবিরে ত্রাণ পাঠিয়েছিলেন। কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের জন্য তিনি খোলাখুলিভাবে সমর্থন দিয়েছেন। স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে অল্প ক’টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো, কানাডা তাদেরই একটি।
       ১৯৭১ সালে ট্রুডোর পাঠানো সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গিয়ে সরেজমিনে প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করে এবং কানাডায় ফিরে গিয়ে ১৯ জুলাই রাজধানী অটোয়ায় একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে জানিয়েছিল যে ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীর সংখ্যা ৬৪ থেকে ৬৮ লক্ষ।  সেই বিবৃতিতে তারা আরও জানান- "পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় আমরা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছি এবং কথা বলেছি ঐসব অসহায় মানুষদের সাথে, যারা পায়ে হেঁটে সীমান্ত পার হচ্ছিলো।  তাদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, তারা নাকি প্রায় দশদিন হাঁটার পর সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে, এবং সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সীমান্ত পার হয়েছে। "
       কানাডার সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রতি ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে একটি সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানানোর পরেও পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। সেই কারণেই কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অস্ত্র অবরোধ আরোপ করেন।
         ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিয়লে প্রোস্টেট ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের এ অকৃত্রিম বন্ধু বিশ্ববরেণ্য নেতা পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডো।

                               

একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পিয়েরে ইলিয়ট ট্রুডোকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিলে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে পিয়েরে ট্রুডোর তরফে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র কানাডার ২৩তম প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। 
 
অস্ট্রেলিয় নাগরিক পল পোয়েরনমো ও তাঁর বন্ধুদের অনশন
 
       একাত্তরে সারা বাংলা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিলো পাকিস্তানি বাহিনী। এর ফলাফলস্বরূপ লাখ লাখ মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। পাক বাহিনীর কঠোরতার কারণে দেশের অভ্যন্তরের হত্যা, জুলুম, নির্যাতনের চিত্র যতটা না বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া এসব উদ্বাস্তু মানুষের ছবি। এ অগণিত সংখ্যক উদ্বাস্তুর দুরবস্থার সংবাদ ও বাস্তব চিত্র বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলো। তাই তাদের সাহায্যার্থে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নানা উদ্যোগ নিয়েছিলো। তেমনই কয়েকজন ছিলেন পল পোয়েরনমো ও তাঁর বন্ধুরা। বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের করুণ অবস্থা দেখে তারা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন এদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। সেই লক্ষ্যেই পল পোয়েরনমো ও তাঁর বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন অনশন করবেন তাঁরা। এভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়দের জাগ্রত করবেন; আর ভারতে আশ্রয় নেয়া মানবেতর জীবনযাপনকারী উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্য অস্ট্রেলীয় সরকারকেও বাধ্য করবেন।

                            

      অনশনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পল পোয়েরনমো। তিনি একজন কবি। “ফ্রিডম ফ্রম হাঙ্গার” নামক একটি সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন এই কবি। একই সংস্থায় কাজ করতেন একজন ভারতীয় গুরু, নাম মেহের বাবা। এই ভারতীয় এক অস্ট্রেলীয় নারীকে বিবাহ করে সেখানেই আবাস গড়েন। যদিও তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তবে তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পান ১৯৬৭ সালে। এই অনশনে পল ও মেহের বাবার সাথে আরও অনেকে সঙ্গী হয়েছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন অন্তত দশ মিলিয়ন ডলারের একটা সাহায্য যেন দেয়া হয় এই শরনার্থীদের। মেলবোর্নের জিপিও’র সামনে শুরু হওয়া অনশন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহর সিডনি ও ক্যানবেরায়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে পল পোয়েরনমো ছাড়া আরও কয়েকজনের নাম জানা যায়। ওয়েন হ্যামিলটন, অ্যাশলে বার্নেট, স্টিভ রুনি, জিওফ ইভান্স, জন হামফ্রে, মার্গারেট সোয়ান, পিটার স্ট্যান্ডবরো, ব্রায়ান গ্রিফিন, ব্রুস ব্রিডয়েস্টার, কেরি বাবা ও ক্রিশিয়ানা ফক্স। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র। মানবতার জন্য এই অনশন প্রকৃয়া সারা অস্ট্রেলিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলো।
      অনশন শুরু হয় ১৩ই সেপ্টেম্বর। ২১শে সেপ্টেম্বর মেলবোর্নের দৈনিক দি এজ পত্রিকার প্রতিবেদক জন লুই পলকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করলেন। পথচারীরা মাঝে মধ্যে অনশনকারীদের দেখে থামতো, কেউ কেউ তাঁর কৌটায় পয়সা ফেলে যেতো, আবার কেউ তাদের হতাশার কথা শোনাতো। তবে পল পোয়েরনমো কিন্তু আশাবাদী ছিলেন।  তিনি বলেছিলেন, এই অনশনের মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারবো ভারতে উদ্বাস্তু এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় খেতে না পাওয়া লোকজন কী যন্ত্রণায় ভুগছে। শিশুরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে এবং একজন দু’জন নয়, হাজারে হাজারে। তাঁর মতে ‘This fast will end in life. For them it ends in death.’

                                                            

       ৩০শে সেপ্টেম্বর থেকে মেলবোর্নের সোয়ানস্টন স্ট্রিটের সেন্ট পল ক্যাথেড্রেলের সামনে সিঁড়িতে শুয়ে অন্য পাচজনের সঙ্গে অনশন করছিলেন ওয়েন হ্যামিল্টন। তাঁর অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পত্র পত্রিকায় অনশনকারীদের প্রতিবেদন ছাপা হতেই চারিদিকে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। দি এজের একজন প্রস্তাব করলেন, অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক যদি এক ডলার করে দান করেন, তাহলে বাংলাদেশী শরনার্থীদের জন্য ১২ মিলিয়ন ডলারের একটি ফাণ্ডের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কার্নেগি থেকে এফ.ই.সি নামে এক ভদ্রলোক নিজে ১০০ ডলার দিয়ে বললেন, যদি কেউ এক ডলারের বেশি দিতে চায় তবে যেন আপত্তি করা না হয়।
       সরকার অনশনকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করলে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পরবর্তীতে তাঁদের গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হয়। দি নিউ এজের মতে সরকার গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করেছে কারণ তাদের মনে হয়েছে, অনশনকারীদের অনশনের কারণটি মহৎ। ৬ই অক্টোবরের সিডনি মর্নিং হেরল্ডের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় পল পোয়েরনমো, স্টিভ রুনি ও জিওফ ইভান্স বিমানে করে মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরা পৌঁছেছেন। বাকী ৩ জন পরের দিন গাড়িতে আসবেন। বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের জন্য যতদিন পর্যন্ত ১০ মিলিয়ন ডলারের ফাণ্ড গঠন না হবে, ততদিন তাঁরা অনশন চালিয়ে যাবেন। 
      ২৫শে অক্টোবর একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। একজন রোমান ক্যাথলিক আর্চ বিশপ, একজন অ্যাংলিকান বিশপ, দাতাসংস্থা এবং পার্লামেন্টের বেশ কিছু সংসদ সদস্য ঠিক করলেন পরেরদিন তাঁরা পল পোয়েরনমোর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবেন। এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয় বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ অনশনকারীদের সমর্থন দেয়। কেউ কেউ পাশে দাঁড়ায়। অস্ট্রেলিয় সরকার ৩ লিমিয়ন ডলার সাহায্যের জন্য রাজী হলে বিরোধী দল, সরকার দলীয় সদস্যদের কাছ থেকেও নেতিবাচক প্রতিকৃয়া আসতে থাকে। নানামুখী চাপের মুখে বিদেশ মন্ত্রী সাহায্যের পরিমাণ ৩ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৫.৫ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেন। পার্লামেন্ট সদস্য জন রিড ঘোষণা করলেন সরকারকে কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, অন্যথায় তিনি সরকারের বিপক্ষে ভোট দেবেন। 
     মেলবোর্নের জিপিওর সামনে থেকে ছোট পরিসরে শুরু হওয়া অনশনটি অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়লো এবং সমগ্র অস্ট্রেলিয়ায় সাড়া ফেলে দিলো। পল পোয়েরনমো ততদিনে হিরো।  বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়লেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পল অনশন চালিয়ে গেছেন। পল ও তাঁর বন্ধুদের এই প্রচেষ্টার ফলে অস্ট্রেলিয়ার সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিলো ৫১,৫৫,০৭২ ডলারে। যে আটটি দেশ বাংলাদেশের শরনার্থীদের সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলো, অস্ট্রেলিয়া তাঁদের মধ্যে অস্টম।  পল পোয়েরনমো ও তাঁর বন্ধুদের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ।

চলমান ...... 

পূর্ববর্তী পর্বগুলো (পর্ব ১-১৬) পড়তে এখানে ক্লিক করুন
 

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 18/09/2021
সর্বমোট 3991 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন