ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

(পর্ব এক): 'বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি এবং বিশ্লেষণ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি হচ্ছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেন-এর বাড়িতে রচিত হয়েছিল। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ২২ বছর বয়সে যুবক নজরুল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোচিত এ কবিতাটি রচনা করেন। যে বাড়িতে বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করা হয়েছিল সে বাড়িটির বার বার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। বাড়িটির সামনের অংশটি অবশিষ্ট থাকলেও পিছন দিকে যে ঘরটিতে বসে কবি বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেছিলেন সেটির সংস্কার ও পরিবর্তন হয়েছে। বাড়িটির বর্তমান মালিক সীমা সাহা। ছয় বছর আগে তিনি পূর্ববর্তী মালিকের কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছেন। এর বর্তমান ঠিকানা: সীমা সাহা, মা বিপদনাশিনী কুঠির, ৩/৪সি তালতলা লেন, কলকাতা- ১৪। ১৯২০ সালে উনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙে গেলে নজরুল বেকার হয়ে পড়েন। আশ্রয়ের খোঁজে তিনি প্রথমে তাঁর সতীর্থ কথাসাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাসায় ওঠেন। সেখানে কয়েক দিন থেকে আরেকটি বাসস্থানে, পরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে উঠেন। সেখানে তাঁর বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ থাকেন। তাঁর সঙ্গে নজরুল একত্রে বসবাস করেছেন আরও কয়েকটি বাসায়। শেষে বসবাস করেন ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাসায়। মুজফ্ফর আহমদ স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন- এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানি নে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। 'বিদ্রোহী' কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধুমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি "চির উন্নত শির" বিরাজমান। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রধানত ১০টি উৎস থেকে বিদ্রোহী কবিতার শব্দগুলি আহরণ করেছিলেন। ১. হিন্দু দেবদেবী-পুরাণ: রুদ্র ভগবান, মহাপ্রলয়ের নটরাজ, অভিশাপ পৃথ্বীর, ভীম, ধূর্জটি, হোম-শিখা, সাগ্নিক জমদগ্নি, যজ্ঞ, ইন্দ্রাণী-সুত, কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ, ব্যোমকেশ, ওঙ্কার, পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, চক্র মহাশঙ্খ, প্রণব-নাদ, ক্ষ্যাপা দুর্বাসা বিশ্বামিত্র শিষ্য, দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস, বৈজয়ন্তী, উচ্চৈঃশ্রবা, বাসুকির ফণা, দেব-শিশু, শ্যামের হাতের বাঁশরী, নরক, বিষ্ণু, ছিন্নমস্তা চন্ডী, রণদা সর্বনাশী, পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয়, হল বলরাম-স্কন্ধে, বিদ্রোহী ভৃগু। ২. ইসলামিক ও আরবি: ইস্রাফিলের শিঙ্গা, বোররাক, জিব্রাইল, হাবিয়া দোজখ, জাহান্নাম, আরশ, কানুন, হাওয়া, ইস্রাফিল, হিম্মৎ, খেয়ালী।‌ ৩. ফার্সি: খোদা, আইন, পঞ্জা, পেয়ালা, হর্দম, খুন, তাজী, জোর, ৪. তুর্কি: কুর্ণিশ ৫. ইংরেজি: সাইক্লোন, টর্পেডো ও মাইন। ৬. গ্রিক মাইথোলজি: অর্ফিয়াস, ৭. ঐতিহাসিক ও সামাজিক: পুরোহিত, সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক, যুবরাজ, বেদুঈন, চেঙ্গিস, স্বেচ্ছাচারী, অরুণ খুনের তরুণ, বিধির দর্পহারী, চির-শিশু, চির-কিশোর। ৮. প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক: হিমাদ্রি, সাইক্লোন, এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর, ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণি, অগ্নি, বজ্র, দাবানল-দাহ, মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ প্রভঞ্জনের উল্লাস, বারিধির মহাকল্লোল, ঢল-উর্মির হিন্দোল দোল, উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া, রুদ্র-রৌদ্র রবি, মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, শ্যামলিমা ছায়া-ছবি, বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, ভূমিকম্প, শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা, উল্কা, শনি, ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী। ৯. নৈর্ব্যক্তিক ভাব-ভাবনা: চির বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর, আমি চির দুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃত্থ্বীর, আমি দুর্বার, আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি মুক্ত জীবনানন্দ, আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চলচঞ্চল, আমি উন্মাদ, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর, আমি শাসন-ত্রাসন সংহার, আমি উষ্ণ চির-অধীর, ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি চির দুরন্ত দুর্মদ, আমি অবসান, নিশাবসান, আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি কভু‌ প্রশান্ত, আমি উজ্জল, আমি প্রোজ্জ্বল, আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ, আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর, আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন-কন, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের, আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত-চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর, আমি যৌবন ভীতু পল্লীবালার আঁচল কাঁচলি নিচোর, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, আমি আকুল নিদাঘ তিয়াশা, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি, আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট, আমি অন্যায়, আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর, অমর, অক্ষয়, আমি অব্যয়, আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়। ১০. বিবিধ জাগতিক বস্তু ও অন্যান্য: টর্পেডো (যুদ্ধবিষয়ক), ভাসমান মাইন (যুদ্ধবিষয়ক), মহামারী, লোকালয়, শ্মশান, বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী‌ মানব-বিজয়-কেতন। বিদ্রোহী কবিতায় ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ও মুক্তির সাধ, বিশ্বমানবিকতা, নির্যাতন-নিপীড়নে দ্রোহ, সত্য সুন্দর ও কল্যাণের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত। এ কবিতায় নজরুলমানস ও প্রতীভার নানা বৈশিষ্ট্য বিধৃত হয়েছে। কবির বাকভঙ্গিমা, অলঙ্কার- জ্ঞান, অসম্প্রদায়িক বিশ্বমানবিক চেতনা, কোরআন-পুরাণের শিল্পসিদ্ধ ব্যবহার-দক্ষতা, আরবি-ফারসিসহ বিদেশি শব্দের সফল প্রয়োগ, প্রতীক ও রূপকল্পের সৃজনে অতুলনীয় মুনশিয়ানা বিস্ময়কর। তা ছাড়াও ছন্দমিল বিশেষত স্বরবৃত্ত ছন্দের এমন অবাধ দোলা ও চলা অভূতপূর্ব। আছে নানা কিংবদন্তি লোকশ্রুতি ও লোকবিশ্বাসের লাগসই কুশলী ব্যবহার। চলবে-

ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 21/09/2021
সর্বমোট 4102 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন