ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

মানিক বন্ধু আমার

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মিরপুরের একটি বাসায় মিঠু ভাই আমাদের চারজনের একটা ব্যাচ করে পড়াতেন। বাড়ির কাছেই ছিলো। আমাদের ক্লাসেই পড়ে কিন্তু অন্য স্কুলের সোহরা সুলতানা নীশি আমাদের চারজনের একজন ছিলো। আমি সোহরা এক ক্লাসে , রাব্বী আর ভাগ্নি মিতু ছিলো জুনিয়র। ঘটানা ক্রমে জানলাম সোহরা লেখালেখি করে। তখনও আমি কিশোর তারকালোক, কিশোর পত্রিকা, শিশু পত্রিকা, কিশোর ভুবন পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। মাসুদ রানা নামে বিভিন্ন ক্যাপশন , শব্দেজট প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন করতাম। বিজয়ী হলে তিনমাসের ফ্রি পত্রিকাও পেতাম। সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, ওয়েষ্ট্রার্ন, অনুবাদ, কিশোর ক্লাসিকের নিয়মিত পাঠক। সোহরা একদিন জানালো ওর খালাতো ভাই ওর চেয়ে ভালো লেখালেখি করে। কোন সংখ্যায় কিশোর ভুবন পত্রিকায় চিঠি পত্র পাতায় পাঠক ফোরাম গঠন নিয়ে আমার একটি চিঠি প্রকাশ হবার পরে সোহরা জানালো ওর ভাই আমার সাথে কথা বলতে চায়।
কোন এক সন্ধায় প্রাইভেট পড়া শেষে সোহরার সাথে ওর বাসায় যাবার পর বুদ্ধিদিপ্ত একটা চোখের সাথে পরিচয় ঘটলো। কথা বলে ভালোও লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা বন্ধু হয়ে উঠলাম। মানিক বন্ধু আমার।
তিনজন আলোচনা করে ঠিক করলাম শহরের যেসব ছেলে মেয়ে কিশোর ভুবন পত্রিকা পাঠ করে তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করবো। এখনকার মত অত সহজ ছিলো না যে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলে দ্রুত সারা পাওয়া যাবে। তিন গোয়েন্দা গল্পে একটি পদ্ধতি ছিলো ”চোখ টু চোখ” আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম এমন একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করবো। চোখ টু চোখ হলো পরিচিত সার্কেলে যার খোঁজ নিবো তার বর্ণনা দিলে সে নজর রাখবে এমন কাউকে দেখা যায় কিনা। আমরা বেশ কয়জনের খোঁজ পেলাম। একেক জনের বাড়ি শহরের একেক প্রান্তে।
মিরপুর স্কুল মাঠের পাশে তখন বাইসাইকেল ভাড়া পাওয়া যেত। একঘন্টায় পাঁচ টাকা করে। আমি আর মানিক সাইকেল ভাড়া করে দুই বন্ধু বেড়িয়ে পড়তাম। আমাদের কাছে বিষয়টি রোমাঞ্চপূর্ণ ছিলো। আমাদের এই পাঠক ফোরাম থেকে এসএসসি পরীক্ষার পর শতদল নামে একটি সংগঠনও তৈরি করেছিলাম। তখন ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি আর এই দিকে নজর তেমন দেয়া হয়নি। শতদলের সভাপতি ছিলো জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান সোহেল ভাই , আমি সাধারণ সম্পাদক আর মানিক ছিলো সাংংগঠনিক সম্পাদক। তখনকার রোটারি ক্লাবে আমাদের মিটিং হতো নিয়মিত। সিরাজগঞ্জ পৌর সভার সামনে ছিলো তখন রোটারি ক্লাবের অফিস।  
 
আমাদের কওমী জুট মিলস্ হাই স্কুল ক্রীড়া আর বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় সিরাজগঞ্জের মধ্যে অন্যতম ইস্কুল ছিলো। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে স্টেডিয়াম মাঠে কুচকাওয়াজ, গ্রামবাংলার ডিসপ্লে প্রদর্শণ এবং বেশিরভাগ সময়ই আমরা চ্যাম্পিয়ন হতাম।
২৫ মার্চ হলো মানিকের জন্মদিন। বন্ধু হবার পরই প্রথম জন্মদিন। একমাস আগেই মানিক জানালো ওর জন্মদিনে অবশ্যই থাকতে হবে। ২৬ মার্চ ভোরে স্টেডিয়ামে যাবো, ২৫ মার্চ ড্রিল টিচার কামরুল ভাই জানালো আমাদের কয়েকজনকে স্কুলে রাতে থাকতে হবে। ডিসপ্লের জন্য বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে হবে। ২৫ শে মার্চ সন্ধার পর ইস্কুল হতে বাড়িতে আসার পর দেখি মানিক গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। বললাম বন্ধু রাত ৮ টার আগেই ইস্কুলে পৌঁছাতে হবে। মানিক বললো আমি অপেক্ষা করছি তুমি রেডি হয়ে আসো। ভিতরে যাবার পর মা জানালো মানিক নাকি এর আগেও কয়েকবার খোঁজ নিয়েছে আমি ইস্কুল হতে ফিরেছি কিনা। মানিকের সাথে ওর বাসায় যাবার পর মানিক জন্মদিনের কেক কাটলো। লজ্জা পেয়েছিলাম পরের বছর মানিকের জন্মদিনে। যার কারনে ওর সামনে অনেকদিন লজ্জায় যেতে পারিনি। সেবারও ইস্কুলের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম। পরের দিন স্টেডিয়াম থেকে বাড়ি আসার পর মা কেক দিলো খাবার জন্য। বললাম হটাৎ কেক কই পেলে। মা জানালো গতরাত ১০ টার পরে মানিক এসে কেক দিয়ে গেছে।
মানিকের সাথে যখন আড্ডা জমলো তখন আমি বেশিরভাগ সময় ফেরারী জীবন যাপন করি। চামড়া গুদামেরর ওখানে আগের রেল ক্রসিং এর সাথে একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মের অফিস ছিলো যেখানে মানিক কাজ করতো। বেশির ভাগ সময় মানিকের সাথে ওখানে বসে আড্ডা দিতাম। আমার অস্থায়ী একটি ঠিকানা গড়ে স্যার। আমাকে কেউ খোঁজ নিতে আসলে মানিকের অফিসে এসে খবর নিতো বা দিতো।
তারপর কতদিন কত সময় মানিক , আমিনুল , সালাউদ্দিন মানে বন্ধু ইঞ্জিনিয়র সাল্টু ,চাঁন মিয়া, রুবেল, হাতুরে ডাক্তার রাসেল, আলম ভাই, কমিনিস্ট বন্ধু ফরিদুল, বর্তমানে হুজুর এককালে গায়েন কনক,বদিউজ্জামান রুবেল আমি বদি বলে ডাকতাম (আমেরিকা প্রবাসী) কত আড্ডা, বছরের পর বছর। আজ হটাৎ সব স্মৃতি হয়ে গেলো।
 
মানিক একজন মেধাবী মানুষ ছিলো। এই যে আজকে আমি ফেসবুক চালাই, যে ইমেইল আইডি ব্যবহার করি এই দুইটাই মানিকের হাতে খোলা। স্কুলের গণ্ডি না পেড়েনো একজন মানুষ কতটুকু মেধাবী হলে জনপ্রিয় ব্লগার হতে পারে। মানিকের কবিতা ,উপন্যাস বই আকারে বের হয়েছে অনেক আগেই। ওর যখন বারোয়ারি উপন্যাস বের হলো , ওকে বললাম বন্ধু একটা বই ফ্রিতে দে অটোগ্রাফ সহ। ওর উত্তর ছিলো কষ্ঠ করে লিখছি পড়ার ইচ্ছে থাকলে কিনে নে। আমি আর আমিনুল সম্ভবত একসাথেই ওর কাছে হতে বইটি কিনেছিলাম। তখন ওরে কত খেপাইছি। শালা কিপটা বন্ধুদের কাছে বই বিক্রি করে। ওর লেখার কোনদিন বানান ভুল পাইনি, ইংরেজীতে দক্ষতা দেখলে মনে হতো ইংলিশ মিয়ামের ছাত্র ছিলো। ওরে আমার সবসময় মনে হতো এ যুগের আরজ আলী মাতুব্বর।
২০১৭ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারির সন্ধায় মানিকের ফোন পেলাম। বললো কই আছিস, চান্দ আলী মোড়ের কথা বলতেই বললো দাড়া আসতেছি। মানিক এসেই বললো চা খাওয়া, বিরি খাওয়া। ওর তখন সিগারেটের সংখ্যা দৈনিক বাড়তেছে। মিনিট ৪০ ছিলো বোধ হয়। যাবার সময় একটি প্যাকেট ধরিয়ে বললো বন্ধু পড়ে নিস পরে জানাস কেমন হইছে। মোড়ক খুলে দেখি অটোগ্রাফ সহ “বিচূর্ণ বিভাস” ওর লেখা। বললাম খাড়া অটোগ্রাফ দিছস এবার ফটোগ্রাফ দে। আমার দেখা মনে হয় মানিকই প্রথম লেখক বা কবি যে অটোগ্রাফ আর ফটো তুলতে অনিহা ছিলো তাও এই সময়ে এই বয়সে। বহুত কষ্টে একটি ছবি তুলতে পেরেছিলাম। কে জানবে ঐ ছবিটি আমার কাছে একমাত্র দুজনের ছবি হবে। বললাম বন্ধু ফেসবুকে কিন্তু পোস্ট করবো কারন তুই যে কঞ্জুস না সবাইকে জানাতে। আমাদের সিরাজগঞ্জের বন্ধু সার্কেলের মধ্যে সম্ভত সাল্টু আর রুবেল ছাড়া আর কেউ ফ্রেন্ডলিস্টে নাই। তখন অদ্ভুত লাগলেও যেহেতু ওরে জানি তাই ওরে এ বিষয়ে ঘাটাতাম না।
করোনা শুরু হবার পর হতে মানিকের দেখা পেতাম না। একদিন আমার এক কাজিন বললো মানিকের মা আমার সাথে কথা বলতে চায় মানিকের বিষয়ে। বললাম কি বিষয়। কাজিন বললো মানিক ভাই নাকি সারাদিন দেবদাসের মত থাকে তাই ওকে বুঝানোর জন্য আমার সাথে কথা বলতে চায়। মানিকের দুটো নাম্বারে ফোন দিয়ে ফোন বন্ধ পেলাম। আমিনুলরে বললাম। আমিনুল বললো কাছাকাছি বাড়ি হবার পরেও নাকি ওর সাথে দেখা হয় না।
একদিন খেদন সর্দার মোড়ে মানিক হেটে আসতেছিলো আর আমি রিক্সায়। মানিককে ডাক দেবার আগেই মানিক নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত। ওটাই ছিলো মানিকের সাথে শেষ দেখা।
গত ১৯ তারিখে বন্ধু হিরক সাবেক ছাত্রনেতা যখন বললো মানিক আর নেই , ঘটনা শুনে একটা ধাক্কা খেয়েছি। আসলে ওর মত বন্ধু সবার কপালে জোটে না। সবার ভাগ্যেও হয় না এমন নির্মল সুন্দর মনের বন্ধু পাওয়া।
ওর কত অভিমান ছিলো কতো কষ্ট ছিলো কেউ জানলাম না আমরা। ওর মত নির্ভৃতচারী বন্ধু আমাদের আর নেই। ওর বোহেমিয়ান জীবনাচরন আমার ভালো লাগলেও ওর জন্য এটা মরণ হয়ে দাড়াবে ভাবিনি কখনও।
গুগুলে জ. ই. মানিক দিয়ে সার্চ দিলে মানিকের অনেক লেখা ভেসে ওঠে। অনেকগুলো ব্লগে নিয়মিত লিখতো। বিভিন্ন লিটলম্যাগে ওর লেখা নিয়মিত প্রকাশ হতো। ওর জন্য কত ধরনের লিটলম্যাগ কিনতে হতো আমাদের বন্ধুদের।
আমার স্মরণে নেই মানিক কখনো আমার কোন সহযোগীতা নিয়েছে বন্ধু হিসাবে ভাই হিসাবে। কিন্তু আমি প্রতিনিয়ত ওর সহযোগীতা পেয়েছি। ল্যাপটপ সমস্যা মানিককে স্মরণ করতাম, মোবাইল সমস্যা মানিক আছে আমার, অনলাইন ব্লগ ফেসবুক কি কিভাবে কি করতে হয় মানিক আছে আমার। আমি স্বার্থের মত মানিকের কাছে হতে নিয়েছি অথচ কখনো ওর জন্য কিছু করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করিস বন্ধু। পণ্ডিত বলে আর কাউকে ডাকতে পারবো না। অথচ ডাকতে খুব ইচ্ছে করছে। ফোন দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে পণ্ডিত আমার ল্যাপটপ একদম বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক করে দে।
 

ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ কেএম শাওন তারিখঃ 23/09/2021
সর্বমোট 877 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন