ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ দুঃসময়ের সারথি - পর্ব-১৯

৭১. আলফ্রেড কাস্টলার, ফ্রান্স
 
        নোবেল বিজয়ী ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রেড কাস্টলারের জন্ম ১৯০২ সালের ৩রা মে, ফ্রান্সের গ্যেবভিলারে। পরমাণুর হার্জীয় রেজোন্যান্স সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য উপযুক্ত আলোকীয় পদ্ধতি আবিষ্কার এবং উন্নয়ন করার কারণে তিনি ১৯৬৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

        একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ফরাসি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন আলফ্রেড কাস্টলার, যিনি পূর্ব বাংলার ভুক্তভোগী মানবতার প্রতি ফরাসি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার প্রকাশ্যে নিন্দা করেছিলেন, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার অসহায় শিশুরা, যারা ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত ছিলো। বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ফরাসি নোবেল বিজয়ী, কাস্টলার, ৮ই অক্টোবর বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদাসীনতার প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন- এই বলে যে, খাবারের অভাবে ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে 'কয়েক দিনের মধ্যে' পূর্ব পাকিস্তানের এক লাখ শিশু মারা যাচ্ছে।  কাস্টলার জোরালো যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে, এই ধরনের একটি ট্র্যাজেডিতে সম্পূর্ণ উদাসীন আর নির্বিকার থাকা উচিত নয়। 
     ফরাসি সাংবাদিকদের একটি দল সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট সকলকে পূর্ব বাংলার ভুক্তভোগী মানবতার পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানিয়েছিল। তাঁরা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল যে, ‘বাংলায় ট্র্যাজেডির সামনে কেউ একজন নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক হতে পারে না' - একটি আবেদন যার উপর একটি ফরাসি দৈনিক, কমব্যাট, সম্পাদকীয়ভাবে ৮ই অক্টোবর বলেছিল যে 'বাঙালিরা সত্যিকারের গণহত্যার শিকার’ এবং এবং যে ‘মানবিকতা তাদের মর্মান্তিক ঘটনার জন্য সম্মিলিতভাবে দায়ী’, এবং সেইজন্য ‘বাংলার অত্যাচারের সঙ্গে জাতিগুলির জড়িয়ে পড়া আমাদের কাছে অপরাধের চেয়েও গুরুতর বলে মনে হয়’। নিউজ পেপারের নিউজের একটি অংশ হয়তো অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়নি, কিন্তু তা প্রকাশ করছে যে, বাঙালি শরনার্থীদের খাদ্য ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি অর্থাৎ তাদের জন্য সাহায্য অপ্রতুল। এছাড়াও সামনে কলেরা মহামারিতে মৃত্যু হবে লাখ লাখ শিশু। এই সংখ্যাটা দাঁড়াবে ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত। এইসব শিশুর যন্ত্রণা আমরা অনুভব করতে পারছি না। তাদেরর আর্তনাদ আমাদেরকে ব্যথিত করছে না। তিনি জাতিসঙ্ঘ, ভ্যাটিক্যান সবার ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, Can a synod which is meeting in Rome for the salvation of mankind continue its work in all serenity? Can the United nation continue their palavers without taking into account as an absolute priority this tragedy with concerns each and every one of us?
           একাত্তরে আমাদের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানো এই বন্ধু ১৯৮৪ সালের ৭ই জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
 
 
৭২.     বাংলাদেশের যুদ্ধে সুইডেনবাসী
 
         বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের অনেক দেশ এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের পক্ষে জোড়ালো সমর্থন জুগিয়েছে। কখনও সরকারীভাবে আবার কখনও ব্যক্তি পর্যায়ে। যেভাবেই হোক, যারা আমাদের পক্ষে যারা অকুণ্ঠ সমর্থন যুগিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই ইস্ট পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। বাংলাদেশ থেকে অনেক অনেক দূরত্বে অবস্থিত ইউরোপীয় দেশ সুইডেনের খুব কম সংখ্যক মানুষই বাংলাদেশের সংবাদ রাখতেন। তবুও সুইডেনের সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বাঙালিদের দুর্দশার চিত্র দেখে আমাদের পক্ষে এগিয়ে এসেছিলেন। শুধু সুইডেনই নয়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের অনেক দেশ যেমন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডেও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিলো।
      
                            লার্স লিজনবর্গ                               গুনার মিরডাল

       একাত্তরে বাংলাদেশের দুর্দিনে এইসব বন্ধুদের একজন ছিলেন লারস লিজনবর্গ। পুরো নাম লার্স এরিক আনসগার লিজনবর্গ। জন্ম ২১শে নভেম্বর, ১৯৪৯, টোবি, সুইডেন। তিনি একজন সুইডিশ রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে তিনি সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেন, এবং চলে যান কলকাতা। নিজ চোখে মুক্তাঞ্চল এবং শরণার্থী শিবিরগুলো ভিজিট করে ফিরে যান সুইডেন। বাঙালিদের অবস্থা দেখে তিনি বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান। লিজনবর্গ একদিকে যেমন শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য সবার প্রতি আবেদন জানান, তেমনি পাকিস্তানকে সুইডেনের পক্ষ থেকে সব রকমের সাহায্য বন্ধ করার জন্য দাবী জানান। এখানেই শেষ নয়, বরং একই লক্ষ্যে তিনি নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ড সফর করে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য যে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন তা পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে। লার্স এরিক আনসগার লিজনবর্গ ২০০৬-২০০৯ মেয়াদে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রী এবং ২০০৬-২০০৭ মেয়াদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। 
       কার্ল গুনার মিরডাল। সুইডিশ ভাষায় উচ্চারণ করা হয় মাইডাল নামে। একজন সুইডিশ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী। জন্ম ডিসেম্বর ৬, ১৮৯৮, স্কাটুংবিন, সুইডেন। ১৯৭৪ সালে, তিনি অর্থনীতিতে নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার পেয়েছিলেন ফ্রিডরিচ হায়েকের সাথে "অর্থ এবং অর্থনৈতিক ওঠানামার তত্ত্বের অগ্রণী কাজ করার জন্য এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনার পরস্পর নির্ভরতার বিশ্লেষণের জন্য। তিনি জাতি সম্পর্ক নিয়ে তার গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক পরিচিত। সুইডেনে, তার কাজ এবং রাজনৈতিক প্রভাব ফোকহেমেট এবং কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি সুইডেনের সংসদে ১৯৩৩ সাল থেকে দীর্ঘদিন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হিসেবে সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছিলেন মন্ত্রী। মিরডালের লেখা অর্থনীতি বিষয়ক অনেক বই রয়েছে। তবে, আমাদের কাছে তাঁর সবচেয়ে পরিচিত বই ‘এশিয়ান ড্রামা’।  মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বাঙালি নিপীড়ন ও শরণার্থীদের দুর্ভোগ-দুর্দশার চিত্র মিরডালের চোখে পড়ে। সেই সময় সুইডেনে তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ সলিডিরাটি কমিটি’। পরবর্তীতে এই সংগঠনটি জনমত তৈরি ও শরণার্থীদের সহায়তা প্রদানে নিরলস কাজ করে গেছে। ১৯৮৭ সালের ১৭ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করে।
                                                              সভেন ওলফ জোয়াকিম পামে

       একাত্তরে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (১৯২৭-১৯৮৬) সভেন ওলফ জোয়াকিম পামে। তিনি ৩০শে জানুয়ারি ১৯২৭ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহন করেন। সভেন ওলফ জোয়াকিম পামে ছিলেন একজন সুইডিশ রাজনীতিবিদ যিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬ এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পামে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৭ সালে তার হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সুইডিশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাঙালিদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, এ বিষয়ে তিনি সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানিদের সব রকমের সহায়তা প্রদানে বিরোধী ছিলেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৬ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি।
      ভান স্ট্রমবার্গ। একজন সুইডিশ সাংবাদিক এবং টেলিভিশনে জনপ্রিয় সংবাদ পরিক্রমা আকতুয়েলৎ এর সমন্বয়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত তাঁর প্রতিবেদন সমূহ বাঙালিদের পক্ষে জনমত সংগঠনে যথেষ্ট সহায়তা করে। পরবর্তীতে তিনি নিজে খুলনা ও যশোরের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন। এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতেন।
        সৈয়দ আসিফ শাহকার। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক ও কবি ছিলেন। বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখতেন এবং লিফলেট রচনা করে গোপনে তা বিতরণ করতেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সুইডেন চলে যান এবং সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে একটি আদালতে বিচারক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
        সুইডিশ বিমান বাহিনীতে চাকুরি করতেন ভেন লামজিল। চাকুরি থেকে অবসর নিয়েই যোগ দিলেন রেডক্রসে। রেডক্রসের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর, এবং তাদের সহায়তাও করতেন। পাকিস্তান কর্তৃক নিযুক্ত গভর্ণর ডা. এ.এম মালেক তাঁর পদত্যাগপত্র লামজিলের কাছেই জমা দেন। যুদ্ধের পর তিনি এক যুদ্ধ শিশুকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন।
২০১২-২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ওলাফ পামকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং উপরে উল্লেখিত সুইডেনের বাকী বন্ধুদেরকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে।

চলমান ............ 

পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। 
 

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 30/09/2021
সর্বমোট 863 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন