ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

যুক্তিযুক্তের বানান বিভ্রাট

উৎসর্গ: নিজেকে।

আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর রাখাটা দোষের। এতোটাই দোষের যে এটা রীতিমত একটা প্রবাদ হয়ে আছে। কিন্তু যে ব্যাপারী এ খরর রাখে তার জন্য এটা যে কত শ্রমসাধ্য কাজ তা সে-ই জানে।
 
মাছিমারা কেরানীর জন্যও কথাটা প্রযোজ্য। হুবহু একই ছুল-ছুরত, সম-স্বাস্থ্য ও আকারের একটা মাছি খুঁজে বের করে, কায়দা করে সেটাকে মেরে, আকার-আকৃতি ঠিক রেখে, গদ দিয়ে সেটাকে যথাস্থানে সেঁটে দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। তার এ সৃজনশীলতাকেও সম্মান না করে ভ্রুকুটি করা হয়। আজিব!
 
প্রমোটি দারোগা আর সরাসরি দারোগার মধ্যেও নাকি বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। প্রমোটি নাকি অফিসার হবার পরেও ছোটলোকি দূর করতে পারে না। অন্যদিকে ডাইরেক্ট অফিসার নাকি ভদ্রলোক হয়। দুজনের কথাবার্তা ও ব্যবহারের কারণেই মনে হয় এ পার্থক্য মানুষের চোখে পড়েছে এবং সময়ের বিবর্তনে এটাও একটা প্রবাদ হয়ে গেছে। কিন্তু ঘুষ খাওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রমোটি দারোগাকে অল্প খাইয়ে খুশি রাখা যায় আর ভদ্র দারোগাকে মোটা অঙ্ক দিতে হয়; সেটি কেউ বিবেচনায় আনে না। এ ক্ষেত্রে প্রমোটি দারোগাই পাবলিকের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের পকেট কম কাটা যায়। এই স্বল্প শিক্ষিত প্রমোটি দারোগাকে ইংরেজিতে লেখা আইনের বই পড়ে বুঝে কাজ করতে হয়। এতে অনেক ভুলভাল হয়ে যায়। তারপরেও সেটি যে তার জন্য কত পরিশ্রমের কাজ তাও কেউ বিবেচনায় নেয় না।
 
বলতে চাচ্ছিলাম বানানের কথা। উপরের তিনটি উদাহরণের সাথে তুলনা করলে এ বিষয়ে যুক্তিযুক্ত যথাক্রমে আদার ব্যাপারী, মাছিমারা কেরানী এবং প্রমোটি দারোগা। স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে বানান দেখতে গিয়ে যুক্তিযুক্ত আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রাখছে। নিজে কিছু না জেনে শুধুই বাংলা একাডেমির অভিধান হুবহু অনুসরণ করে মাছিমারা কেরানীর কাজ করছে। এবং পেশাগতভাবে তিনি বা তার চৌদ্দ গুষ্টির কেউ-ই বানান জাতীয় পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও তিনি প্রমোটি দারোগারমত প্রুফ রিডার সেজে বসে আছেন। যদিও এটা যুক্তিযুক্তের চর্চিত বাস্তবতা কিন্তু এ ক্ষেত্রে লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া যুক্তিযুক্তের পরিশ্রমী কষ্টটুকু হয়ত অনেকেরই আমলে নেবার ফুসরত হচ্ছে না।
 
বাংলা বানানের মহর্ষি, বাংলা একাডেমি। যদিও এর নিজের নামেই ভ্যাজাল। বাংলা বানান ও চর্চার দাস-খত নেওয়া এ প্রতিষ্ঠানটির নাম বাংলায় হতে পারত। তা হয়নি। ‘একাডেমি’ শব্দটি বাংলা শব্দ নয়। আবার ‘একাডেমি’ বানানটি নিয়েও ধূমজাল আছে। ম-য় হ্রস্বই-কার হবে নাকি ম-য় দীর্ঘই-কার হবে এ নিয়ে বহুদিন যাবত বিতর্কের পরে সর্বশেষ সংস্করণে ম-য় হ্রস্বই-কারকে গ্রহণ করা হয়েছে। ম-য় হ্রস্বই-কারকে গ্রহণ করার মানে হচ্ছে এটি ইংরেজি শব্দ। ইংরেজি বা যে কোন বিদেশী শব্দের উচ্চারণ বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে সকল ক্ষেত্রেই হ্রস্বই-কার ব্যবহার করতে হবে মর্মে বাংলা একাডেমি যে বিধান নাজিল করেছে, সেটিকে আমলে নিলে যুক্তিযুক্তের বিবেচনায় এটিই দাঁড়ায়।
 
বিদেশী শব্দের উচ্চারণ বাংলা ভাষায় লেখার ক্ষেত্রে শ, ষ ও স এর ব্যবহারেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোন মূর্ধন্য-ষ ব্যবহার হবে না। সাধারণত শব্দের শুরু ও শেষে দন্ত-স এবং মাঝে তালব্য-শ ব্যবহার হবে। সকল ক্ষেত্রে দন্ত-স ব্যবহার করলেও কোন ভুল হবে না। কিছু ব্যতিক্রম আছে, সেগুলি আমার মনে নেই। 
 
‘বাংলা একাডেমি’র নাম পরিবর্তন করার জন্য ছোটখাটো প্রতিবাদ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। যদিও তা একেবারেই বাংলা একাডেমির বইমেলা কেন্দ্রিক, ফলে তা হালে পানি পাচ্ছে না। বিগত তিন বছর যাবত দেখছি বই মেলার ‘লেখক আড্ডা’য় অখ্যাত কবি প্রত্যয় জসীম প্রতিদিন বিকেলে এর প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। তার সাথে আছেন নকল নবিশ কবি দিলদার হোসেন এবং আরও কয়েকজন। আমাকেও টেনে-হিঁচড়ে কয়েকদিন সেখানে হাজির করা হয়েছে।
 
জসীম ভাই প্রতিদিনই জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার বক্তব্যে ‘বাংলা একাডেমি’র দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিদেশি দালাল বলা থেকে শুরু করে তাদের অপসারণ এবং সময় হলে জনগণ যে তাদের উচিৎ জবাব দিয়ে পশ্চাতে আঘাত দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেবে- এ সবই উঠে আসছে। যদিও তার জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদানের সময়ে সামনে শ্রোতা খুব একটা থাকে না। বরং বক্তব্যের সময়ে আমরা পাশে থাকা দু/চার জন তাকে খোঁচা মেরে বলি, “চালিয়েজান গুরু, সাথে আছি।” এতে জসীম ভাইয়ের বক্তব্যের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং তিনি গোড়ালি উঁচু করে পায়ের পাতার উপরে ভর করে সাতই মার্চের অনুকরণে আঙ্গুল উঁচিয়ে গালিগালাজ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে বক্তব্য দিতে থাকেন। আমরা মিটি মিটি হাসি।
 
বানানের ব্যাপারে অনেক নিয়ম-কানুন, ইতিহাস, ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি অনুসরণ করে তবেই বানান নির্ধারণ করা হয়। যদিও কখনও কখনও এ নিয়ম মনে রাখার চেয়ে বানানটি মুখস্থ করে ফেলাই আয়াসসাধ্য। আমার আজকের বিষয় তা নিয়ে। যেখানে নিয়ম মনে রাখার জন্য বানান ভুল হবার সম্ভাবনা বেশি সেগুলিকে পরিবর্তন করে যে নিয়মকে অনুসরণ করে বানানটি লেখা হচ্ছে সেটিকে গ্রহণ করলে ভাল হয়। যেমন- ‘জরুরি’ বানানটি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ‘জরুরী’ লেখা হতো, যা ভুল। বাংলা একাডেমি এক সময়ে ‘জরুরী’ বানানটিকেও শুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
 
আমি যে বানানগুলিকে শুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে তার কয়েকটির উদাহরণ দেই-
 
‘বার’, ‘দিন’ অর্থে ঠিক আছে কিন্তু ‘সংখ্যা’ অর্থে আমি ‘বারো’ লেখার পক্ষপাতী। যেমন- রবিবার, বারো কোটি।
 
‘হল’, ‘কামরা‘ অর্থে ঠিক আছে কিন্তু ‘করা’ অর্থে আমি ‘হলো’ লেখার পক্ষপাতী।  যেমন- টাউন হল, সমাপ্ত হলো।
 
‘হল’ এর মত একইরকম শব্দ ‘এল’ বানানটি ভুল। এটি হবে ‘এলো’। বানানটিতে দুরকম অর্থেই ও-কার আছে। যেমন- এলোচুল, চলে এলো।
 
‘বল’ বানটি খুবই বিভ্রান্তিকর। বল খেলে, আর কথা বল- এক উচ্চারণ নয়, অর্থও এক নয়। তাহলে কথা বলা অর্থে বানানটি ‘বলো’ কে শুদ্ধ ধরলে সমস্যা কি!
এরকম অসংখ্য শব্দ আছে।
 
কিছু কিছু বানান নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে সহজ হবার পরিবর্তে বরং বেশি বেশি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। এগুলির জন্য সহজিয়া নিয়ম করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। যেমন-           
  
নিচের প্রায় প্রতিটি বানানই শুদ্ধ অথচ বর্ণ বা অক্ষর বিন্যাসের কারণে, সহযোগী চিহ্নের ভিন্ন ব্যবহারের কারণে বা অর্থ ভিন্নতার কারণে এগুলিতে প্রচণ্ড রকম বানান সমস্যা হয়। আমার হয়, অন্যের কথা জানি না।
 
বৈশিষ্ট্য>বিশিষ্ট = দুটো বানানই সঠিক। অথচ ঐ-কার ও হ্রস্বই-কারের কারণে একটায় জ-ফলা আছে অন্যটায় নাই। আমি এ জন্য প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হই। জ-ফলা রাখার বিষয়টিও আমার কাছে পরিষ্কার না। এটা না থাকলে খুব বড় কোন সমস্যা হয় বলে আমার মনে হয় না।
 
ইচ্ছেমত>ইচ্ছামতো= দুটো বানানই সঠিক। অথচ চ্ছ-য় সংযুক্ত বর্ণে এ-কার ও আ-কারের কারণে একটাতে শুধু ত, অন্যটায় ত-য় ও-কার। আমি এ জন্য বিভ্রান্ত।
 
মনোযোগ>মনযোগী= দুটো বানানই সঠিক। প্রথমটার শেষে শুধু গ থাকার কারণে ন-য় ও-কার হয়েছে। পরেরটায় গ-য় দীর্ঘই-কার থাকায় শুধু ন হয়েছে। এটিতে আমি বিভ্রান্ত।
 
নিরূপণ>নিরুপম= দুটো বানানই সঠিক। প্রথমটার শেষে ণ থাকার কারণে র-য় দীর্ঘউ-কার হয়েছে। পরেরটায় ম থাকার কারণে র-য় হ্রস্বই-কার হয়েছে। এটি আমাকে বিভ্রান্ত করে।
 
শিল্পিত>শিল্পীর= দুটো বানানই সঠিক। প্রথমটার শেষে ত থাকার কারণে হ্রস্বই-কার হয়েছে। পরেরটায় র থাকার কারণে  দীর্ঘই-কার হয়েছে। এটিও আমাকে বিভ্রান্ত করে।
 
সুদূর>সুদুরি= দুটো বানানই সঠিক। প্রথমটার শেষে র থাকার কারণে দ-য় দীর্ঘই-কার হয়েছে। পরেরটায় র-য় হ্রস্বই-কার থাকার কারণে দ-য় রস্বউ-কার হয়েছে। এটিও আমাকে বিভ্রান্ত করে।
 
প্রাণী>প্রাণিসম্পদ এবং  শ্রেণি>শ্রেণীবিন্যাস= শব্দ চারটি খেয়াল করে দেখুন। শুধু ‘প্রাণী’ লিখতে ণ-য় দীর্ঘই-কার অথচ ‘প্রাণিসম্পদ’ শব্দটি লিখতে ণ-য় হ্রস্বই-কার। একই রকম শব্দ ‘শ্রেণি’ ও ‘শ্রেণীবিন্যাস’ লিখতে ঠিক তার উল্টো নিয়ম। তাছাড়া ‘শ্রেণী’ বানানটি যুগযুগ ধরে আমরা লিখে অভ্যস্ত। কি দরকার ছিল এটিকে পাল্টানোর? এগুলোকে খুব ফালতু পণ্ডিতি মনে হয়। একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। 
 
বাকবাকুম>বাকবাকম>বকবাকুম>বকবকুম= বানানগুলি খেয়াল করে দেখুন। কি আশ্চর্য। এর মধ্যে প্রথম শব্দটিই আমরা লিখে অভ্যস্ত বাকিগুলি নয়। অথচ এখানে এই প্রথম শব্দটিই বানানে ভুল, বাকীগুলি সব ঠিক। কোন মানে হয়! এগুলোকেও খুব ফালতু পণ্ডিতি মনে হয়। এর কোন প্রয়োজন ছিল না।
 
কর>করো= দুটো বানানই সঠিক। এটিও আমাকে বিভ্রান্ত করে। পুরুষ ভেদে এর উচ্চারণ ভিন্ন, ফলে সেভাবেই এর শুদ্ধতা নির্ণয় করা দরকার বলে মনে হয়।
 
নীরবে>নিরলে= দুটো বানানই সঠিক। প্রথমটার শেষে ব থাকার কারণে ন-য় দীর্ঘই-কার হয়েছে। পরেরটায় ল থাকার কারণে ন-য় হ্রস্বই-কার হয়েছে।
 
নৈশব্দের>নৈঃশব্দ্যের>নিঃশব্দের>নৈশব্দর= বানানগুলি খেয়াল করে দেখুন। সবগুলিই শুদ্ধ বানান। কি আশ্চর্য। এখানে বিসর্গ, ঐ-কার আর জ-ফলা আমাকে জ্বালিয়ে মারে। যতবার লিখি ততবার অভিধান দেখতে হয়। এগুলোকেও খুব ফালতু পণ্ডিতি মনে হয়। এর কোন প্রয়োজন ছিল না।
 
শূয়রের>শুয়োরের= শ-য় হ্রস্বই-কার আর দীর্ঘই-কার নির্ভর করছে য় একা এবং ও-কার সহ ব্যবহারের উপরে। খুবই বিভ্রান্তির বিষয়।
 
বিষণ্ণ (ণ+ণ) ও বিপন্ন (ন+ন)= আমার কিছু বলার নাই। নিয়মের কারণে পণ্ডিত ব্যক্তিদের উপরে সম্মান হারিয়ে ফেলি।
 
সুতোয়>সূতায়= স-য় হ্রস্বই-কার আর দীর্ঘই-কার নির্ভর করছে ত-য় ও-কার ও ত-য় আকারের উপরে। কোন দরকার ছিল?
 
বানানের ব্যাপারে আমি সবসময়েই খুব বিভ্রান্ত থাকি। কেউ আমাকে খুব সহজ বানান জিজ্ঞাসা করলেও আমি খুব বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। অভিধান না দেখে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। এ জন্য লিখতেও আমার অনেক সময় লেগে যায়। অন্যের লেখা পড়তে আমার যতোটুকু সময় লাগে, সে সময়ে অনেকে ওরকম আরেকটা লেখা লিখে ফেলতে পারে। এ সবই আমার ব্যর্থতা। কখনও কখনও মনে হয় আমারমত ব্যর্থ মানুষদের কথাও যদি পণ্ডিতরা একটু ভাবত তবে খারাপ হতো না বরং অনেকেই বেঁচে যেত।
 
আদার ব্যাপারীকে জাহাজের খবর রাখার দুঃসাহস দেখানোর জন্য ক্ষমা করবেন আশাকরি। ক্ষমা করে যেতে হবে, কারণ আমি খবর রাখা ছাড়ব বলে মনে হয় না।  
 

ছবি
সেকশনঃ ব্লগরব্লগর
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 07/12/2014
সর্বমোট 7158 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন