লেখাটি মজার অভিজ্ঞতাগুলো
শেয়ার করা নিয়ে। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলো কিংবা আরও পরে তারুণ্যে ভরপুর সময়গুলো কখনো
পুরনো হয় না, বার বার ফিরে আসে। কখনো আনন্দে দোলায়, আবার ভারাক্রান্ত করে গভীর
বিস্বাদে। তবুও সে সময়গুলোই আমাদের জীবনে সোনালী অধ্যায় হিসেবে গণ্য হয়। আসুন দুঃখ
ভুলে সবাই মিলে কিছুক্ষণ মজার মজার ঘটনাগুলো শেয়ার করি।
১.
নানাবাড়ির অনতিদূরেই
ছিল হাজী সাহেবের ছাড়াবাড়িটি। হরেক রকমের ফলের গাছে পরিপূর্ণ ছিল সে বাগান, যা
আমাদের মত পাঁজি নচ্ছাড়দের জন্য ছিল এক স্বর্গোদ্যান। বছরের বিভিন্ন সময়ে কোন না
কোন ফলের সমারোহ থাকতোই। হাজী সাহেবের বোনটি ছিল দারোগা মেজাজের, সারাক্ষণ বাগানের
দিকে ছিল তার তীক্ষ্ণ নজর। নজর যতই তীক্ষ্ণ হোক, আমাদেরকে দমিয়ে রাখা কি তার কম্ম!
বিশাল বাগানের একদিক থেকে তাড়িয়ে দিলে অন্যদিক দিয়ে ঢুকে চলত আমাদের দস্যূপনা! আম,
জাম, জামরুল, পেয়ারা, নারিকেল কিংবা বড়ই- যখন যা হত অর্ধেকের বেশিই যেত আমাদের
পেটে। আজকের এই সময়ে এসে দেশী-বিদেশী আর যত দামী ফলই খাইনা কেন সেই হাজীর বাগান
থেকে চুরি করে খাওয়া টসটসে একটা কালো জামের স্বাদ আর পাইনা!
২.
পরীক্ষা শেষে প্রতি
ডিসেম্বরে দল বেঁধে গ্রামে বেড়াতে যাওয়া ছিল অবধারিত। আমি আর আমার সমবয়সী কাজিন
শ্যামল সবসময় একসাথেই যেতাম। গ্রামে এই সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকত আরেক কাজিন তমাল
আর আমাদের থেকে বয়সে কিছুটা বড় এক মামা। বয়সে বড় হলেও আমরা ছিলাম বন্ধুর মত। আমরা
বাড়িতে গেলে ওর দলের শূন্যস্থানটা যেন পূর্ণ হত। শুরু হত দুষ্টুমির নানা প্ল্যান।
একদিন বিকেলে নানাবাড়ি
লাগোয়া খালের পাড়ের বসে গল্প করছি হঠাৎ শ্যামল বলল- ইশ! খাসীটা খেতটা নষ্ট করে
ফেলছে! আমিও দেখতে পেলাম নাদুস নুদুস এক খাসী মনের সুখে খালের ঐ পাড়ে কারো শস্যখেত
সাবাড় করছে। আমাদের মামুর দিকে তাকিয়ে দেখি- ও কি যেন ভাবছে, দৃষ্টি খালের ঐ পাড়ে
নিবদ্ধ। একসময় উঠে বলল-তোরা বসে গল্প কর আমি একটু আসছি। প্রথমে আমরা বুঝে উঠতে
পারিনি কিছুই, কিছুক্ষণ পর দেখি ওর আরও কয়েকজন বন্ধু নিয়ে হাজির। বলল- মামা রাইতে
স্কুলঘরে আমরা পিকনিক করমু। আমরা তো অবাক। বলা নেই কওয়া নাই পিকনিক করবা!
জিনিসপত্রের জোগাড় করতেও তো সময় লাগবে। ও বলল- ওসব নিয়া তোমগো ভাবতে হইব না, আমি
ব্যবস্থা করতাছি। সন্ধ্যার পর দেখি ওর বন্ধুদের নিয়ে বেশ কিছু বাজার করে নিয়ে এল।
নানীর ভাণ্ডার থেকে পোলাও চালও চলে এল, এবার প্রয়োজন মাংসের। আমরা বললাম আমরা
শেয়ার করি? ও বলল- না না, তোমরা হইলা মেহমান, তোমাদের শেয়ার করতে হইব না। চিন্তা
কইরো না, মাংসের ব্যবস্থা আমি করতাছি। জিনিসপত্র সব স্কুলঘরে জমা হচ্ছে। রাত নয়টার
দিকে ওর বন্ধুদের নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল, আমরা বললাম এই মামু আমরাও যাই! তোরা যাবি?
একটু ভেবে বলল- না থাক, তোরা বরং বাড়ির ভেতর থেকে মসলাগুলো পিসিয়ে রাখ আর
আলু-পিয়াজগুলো কাইটা রাখ, আমি মাংসের ব্যবস্থা করে তোদের ডাকছি। বাড়ির ভিতর থেকে
পোলাপান দিয়ে এই কাজগুলো করিয়ে রাখতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মামু এসে হাজির।
বাড়ির ভিতর থেকে ছুরি, বড় বল নিয়ে এসে বলল- মামা চল, নদীর পাড়ে। শীতের রাতে ভারী
সোয়েটার জড়িয়ে আমি, তমাল আর শ্যামল মামুর পিছন পিছন নদীর দিকে যাচ্ছি। নদীর পাড়ে
গিয়ে আমাদের কাছে সবকিছু দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। এ তো সেই খাসী! বিকেলে
খালের পাড়ে চড়তে দেখেছিলাম! বলল শ্যামল। যাই হোক, খাসী জবাই করে চামড়া ছাড়িয়ে মাংস
স্কুলঘরে এনে টুকরা করা হল। রাতে
যথারীতি নদীর চরে ছাগুটির ভবলীলা সাঙ্গ করে স্কুল ঘরে সবাই মিলে ভুরি ভোজন সারলাম!
সকালে উঠে দেখি খালের ওপাড়ের হাওলাদার বাড়ির একটি
দল আমার রাশভারী নানাজীর দরবারে হাজির। আমার গুণধর মামু ঘটনা আঁচ করেই পগার পার! পরে অবশ্য সেই খাসীর দাম
পরিশোধ হয় নানাজীর গোলা থেকে চুরি করা ধানের মূল্য দিয়েই।
৩.
এই মামুরই আরেকটি
ঘটনা ছিল মুরগী চুরি নিয়ে। মুরগীর মালিক ছিল তার ছাত্রী কাম তৎকালীন গার্লফ্রেন্ডের
(গ্রামের ছেলেদের ভাষায় লাভার) বাবার। অন্ধকার রাত, আমাদের দু,ভাইকে নিয়ে বের হল।
চেনাজানা রাস্তা থাকায় সে স্বচ্ছন্দে চলছিল আর এডভেঞ্চারের নেশায় আমরাও তার পিছনে হোচট
খেতে খেতে খালের পাড়ের সরুপথ ধরে এগিয়ে চলছি। গ্রামের বাড়ির মুরগীর খোয়াড়গুলি
বানানো হত মাটি দিয়ে, উপরের ফাঁকা অংশে ভারী কাঠ দিয়ে ঢেকে রাখা হত যাতে শেয়াল
কিংবা অন্য কোন প্রাণি মুরগী নিয়ে যেতে না পারে। আমাদের খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে
রেখে যথারীতি মামুজান গিয়ে মুরগীর খোয়াড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। উপরের কাঠ সরিয়ে যেই
না মামু ভিতরে হাত ঢুকিয়েছে, অমনি মুরগীর চেঁচামেচিতে গৃহস্থের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ভিতর থেকে- “অ্যাই কেডারে ?????” হাঁক শুনতেই মামুজী দিল খিইচ্চা এক দৌড়। আমরা
দু’ভাই অন্ধকারে অচেনা পথে দৌড়ে কই যাই!! কিছু বুঝতে না পেরে রাস্তা থেকে খালের
পাড়ের দিকে নেমে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। কুপি বাতি জ্বালিয়ে গৃহস্থ কিছু খুঁজে না
পেয়ে বেজী কিংবা খাটাশ মনে করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তাপর মামুজান আড়াল থেকে বেরিয়ে
এসে আমাদের কাছে আসতেই দিলাম দুজন মিলে আচ্ছা রামধোলাই! তবে ধোলাই দিলে কি হবে-
ঘটনাটা মনে পড়লে এখনও মজা পাই, আর মামুরে ক্ষেপাই।
এবার অন্যদের পালা। সবাই যার যার ঝুলি থেকে বের করেন –
অভিজ্ঞতার ভান্ডার!