কিছুক্ষণ আগে এখানকার মানুষের রহস্যময় আচরণের বিষয়টা এতক্ষণে পরিস্কার হল জামিলের কাছে। সে দারোগার উদ্দেশ্যে বলল,
কিন্তু এই ঘটনার সাথে আমার সম্পর্ক কী? আমি তো এখানকার কেউ না! তাছাড়া এখানে মাত্র আজই এলাম।
আমার কিচ্ছু করার নেই। উপর মহলের নির্দেশ। তদন্ত শেষ হলে চলে যাবেন।
তা কী করে হয়? এখানে আমি থাকব কোথায়? কোন হোটেলও তো নেই।
সেটা একটা ভাবনার বিষয় বটে! কিছুক্ষণ চুপ থেকে দারোগা হঠাৎ রাজিব সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে বলল- আপনার বাড়িতে তো অনেক ঘর, ওনাকে একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
রাজিব সিদ্দিকী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। দারোগা আবার বলল- কী কমিশনার সাব, আপনার বাড়িতে ভদ্রলোককে রাখা যাবে না?
এবার আমতা আমতা করে বলল রাজিব সিদ্দিকী - তা না হয় রাখলাম, মেহমান হল লক্ষ্মী; কিন্তু দারোগাসাব এই ভদ্রলোক তো আইজই আইলেন, ওনারে এর মধ্যে জড়ানো কী ঠিক হবে?
সে ভাবনা আমাদের ভাবতে দেন। আপনে শুধু ক’দিনের জন্য ওনার থাকার ব্যবস্থা করেন। তদন্ত শেষ হলেই উনি চলে যাবেন।
রাজিব সিদ্দিকীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দারোগা উঠে দাঁড়াল। গাড়ির দিকে এগিয়ে আবার ঘুরে তাকাল। রাজিব সিদ্দিকীর উদ্দেশ্যে বলল-
আর হ্যা, নজু মিয়াকে কাল সকালে থানায় পাঠাবেন।
রাজিব সিদ্দিকী কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- থানায়!
দারোগা হেসে বলল- ভয় নেই, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলেই ছেড়ে দেব। সাথের কন্সটেবলকে জামিলের নাম-ঠিকানা লিখে নিতে বলে দারোগা গাড়িতে গিয়ে বসল।
রাজিব সিদ্দিকী কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থাকল। তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। এই বিরক্তি দারোগার আচরণের জন্য না-কি জামিলকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিতে হবে সে জন্য ঠিক বোঝা গেল না। বলরাম হালদার খোঁচা দিতে ছাড়ল না। সে বলে উঠল-
নাও, এইবার মেহমানকে তোমার বাড়িতে নিয়া যাও। ঠিকমত আপ্যায়ন কইরো, নইলে দারোগা আবার তোমার উপরে একচোট নিতে পারে!
রাজিব সিদ্দিকী বলরাম হালদারের কথার কোন উত্তর দিল না। জামিলের উদ্দেশ্যে বলল,
চলেন ভাই। রাইত হইয়া যাইতেছে।
রাজিব সিদ্দিকীর বাড়িটি বাজার থেকে বেশ দূরে। কিছুদূর এগোতেই ব্যস্ত শহুরে জনপদ শেষ হয়ে এল। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। গ্রামের মধ্য দিয়ে দু’জনে এগিয়ে চলছে। রাজিব সিদ্দিকী বেশ চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল সে,
বুঝলেন ভাইসাব, আমাদের দেশের পুলিশগুলার ব্যবহার খুব খারাপ। মানুষ ক্যামনে তাদের বন্ধু ভাববে, বলেন? এই দ্যাখেন, আপনারে হুদাহুদাই ঝামেলায় ফালাইয়া দিল।
আসলে ঠিক কি ঘটেছে, কে খুন হয়েছে? জামিল জানতে চাইল।
যাত্রাদলের এক বুড়ারে কারা যেন মাইরা ফালাইছে, আর একটা নর্তকীরে খুঁইজা পাওয়া যাইতাছে না।
কীভাবে খুন হল?
ক্যামনে কমু ভাই! মনে হয় অগো দলের মধ্যের কারও কাম হইবো। আমগো এলাকার মানুষ খুব শান্তিপ্রিয়, এইহানে খুনাখুনি করার মত লোক নাই।
আমি ভাবছি, এই ঝামেলায় কতদিন এখানে আটকে থাকতে হয়!
যাত্রাদলের কয়েকজনকে আটক করছে, মনে হয় খুব তাড়াতড়ি একটা সুরাহা হইয়া যাবে।
কথা বলতে বলেই তারা পৌছে গেল। রাজিব সিদ্দিকীর বাড়িতে ঢোকার মুখেই কাছারিঘরটি। লম্বা আকৃতির ঘরটির দু’পাশে দু’টি বিছানা পাতা। এ বাড়ির কাজের লোক নজু মিয়া এসে জামিলের জন্য বিছানাটা ঝেড়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে সেই যে অদৃশ্য হয়েছে আর ফেরার আসার নাম নেই। জামিল একা একা বসে থেকে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘরের ভেতরেও আলোর স্বল্পতা যথেষ্ট। কাছারিঘরের সামনের খোলা জায়গায় নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলো জামিল। একটু এগোতেই বাম পার্শ্বে বড় একটি পুকুর। পুকুরের অপর প্রান্তে ঘন জঙ্গল।
জামিল পুকুরের ঘাটে এসে বসল। এখন থেকে ভেতর বাড়িতে ঘরগুলোয় আলো জ্বলতে দেখা যায়। এ বাড়িতে এসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হল, কিন্তু রাজিব সিদ্দিকী আর নজু মিয়া ছাড়া আর কেউকেই দেখেনি। কিছুক্ষণ পর অবশেষে নজু মিয়া জামিলের রাতের খাবার নিয়ে ফিরে এল। টেবিলে জামিলের খাবার সাজিয়ে নজু মিয়া তার বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।
জামিল খাওয়া সেরে একটা সিগারেট ধরিয়েছে, এমন সময় রাজিব সিদ্দিকী এসে ঘরে ঢুকল। মাফলারটা গলায় জড়ানো। কাশতে কাশতে বলল,
ক’দিন ধরে ঠাণ্ডায় খুব ভুগতেছি। ভাইসাব, আপনের কোন সমস্যা হইতাছে না তো!
না না, কোন সমস্যা নেই। আমি এসে বরং আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
রাজিব সিদ্দিকী অনেকটা আফসোসের সুরে বলল- আমাদের আর ঝামেলা কি, দারোগাই তো আপনারে বিপদে ফেলল।
জামিল হেসে বলল, আইনের লোকজন কিছুটা এমনই হয়ে থাকে। যান, আপনে গিয়ে রেস্ট নেন।
নজু মিয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে জোরে হাঁক দিয়ে উঠল রাজিব সিদ্দিকী।
নজু!
তাড়াতাড়ি উঠে রাজিব সিদ্দিকীর কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় নজু মিয়া।
ঐ বেয়াদব, সাহেব একা একা বসে আছে আর তুই গিয়া শুয়ে আছোস! দেখ ওনার কি লাগে। বিদেশী মানুষ, খেয়াল রাখবি ওনার যেন কোন অসুবিধা না হয়।
নজু মিয়া ঘাড় নেড়ে সায় জানায়।
রাজিব সিদ্দিকী চলে যাওয়ার পর নজু মিয়া জামিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। দৃষ্টি মাটির দিকে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
স্যার, আর কিছু লাগবে?
না। কিছু লাগবে না।
জামিলের ঘুম পাচ্ছিল না। আবার এই অচেনা পরিবেশে একা ভালও লাগছিল না। তাই ভাবল, নজু মিয়ার সাথে কথা বলে কিছুটা সময় কাটবে। সে হেসে বলল,
তোমার কি খুব ঘুম পাচ্ছে নজু?
নজু মিয়া চুপ। জামিল তার দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে জানাল তার ঘুম পাচ্ছে না।
তাহলে বস, আমরা কিছুক্ষণ কথা বলি।
নজু একটা বেতের মোড়া নিয়ে জামিল থেকে একটু দূরে বসল।
জামিল এই প্রথম ভালভাবে দেখল নজুকে। বয়স বিশ-একুশের মত হবে। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, চোয়ালটা ভাঙা। বড্ড বেশি চুপচাপ। সে মনে মনে ভাবল, এটা কি ওর স্বাভাব নাকি নতুন মানুষ দেখে এমন করছে। জামিল কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।
এই বাড়িতে তুমি কতদিন আছ?
পাঁচ বছর।
তাই! অনেক লম্বা সময়। তাহলে তো তুমি সিদ্দিকী সাহেবের অনেক বিশ্বস্ত একজন।
নজু কোন উত্তর দেয় না।
জামিল হেসে বলে, নজু তুমি কি কোন কারণে বিরক্ত?
নজু মিয়া জামিলের দিকে তাকায়। মুখে কিছুই বলে না।
এখানে আসার পর এই প্রথম তাকে চোখ তুলে তাকাতে দেখল জামিল। তার দৃষ্টি কিছুটা অস্বাভাবিকও মনে হল। কেমন যেন অস্থির চাহনি, কিছুটা আতঙ্কগ্রস্থ।
নজু, আমার এ বাড়িতে আসার কারণ কি তুমি জান?
নজু ছোট্ট করে উত্তর দেয়- না।
শোন নি, তোমার সাহেব কি বলল? দারোগা আমাকে আটকে দিয়েছে। এক ধরণের এরেস্ট করাই বলতে পারো। লকআপে ঢোকায়নি, আবার ছেড়েও দেয়নি। হাসতে হাসতে বলল জামিল।
নজুর ভিতরে কোন ভাবান্তর নেই। সে নির্বাক শ্রোতার মতই কেবল শুনে যাচ্ছে।
তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না দারোগা আমাকে কেন আটকে দিল?
নজু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জামিলের দিকে তাকালো।
তোমাদের এলাকায় একটা খুন হয়েছে, জান তো?
হ।
আসলে ঠিক কি ঘটেছিলো আমাকে বলবে?
নজু কোন কথা বলছে না। জামিল হেসে আবারও জিজ্ঞেস করল- কি, কিছু বলবে না?
নজু গম্ভীরভাবে জবাব দিল- আমি কিছু জানি না।
কী বল! এলাকার সবাই তো জানে, তুমি জান না?
শুনছি যাত্রাদলের একজন মানুষ খুন হইছে।
তুমি যা জান তা-ই বল।
চলবে......
অচেনা আগন্তুক – পর্ব-১