পর্ব উৎসর্গঃ চে এবং অকিঞ্চন জন
তিব্বতি যোদ্ধা, এসএফএফ
একটা যুদ্ধ যেমন কেড়ে নেয় অনেক কিছুই, আবার সেই দুঃসময়ে অনেক বন্ধুও
মিলে যায়, যারা সুখ দুঃখের অংশীদার হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এ রকম বন্ধুর
সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকের কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয় আবার অনেকে থেকে
যান আড়ালে। মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের আমারা সঠিকভাবে
মূল্যায়ন করতে পারিনি। অনেক বন্ধুদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল
ইতিহাস এখনো আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। তেমনই কিছু যোদ্ধা যারা আমাদের
মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জান বাজি রেখে সম্মুখসমরে লড়েছিলেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর প্রথম যে বিদেশী সুশিক্ষিত বাহিনী আমাদের
হয়ে লড়েছিল তারা হলেন এই তিব্বতি বাহিনী- এসএফএফ। চীনের বিরুদ্ধে ভারতের
হয়ে লড়ার জন্য গঠিত রেজিমেন্ট- স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স যা এসএফএফ নামেই
পরিচিত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনস্ত হয়ে নয়, বরং তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের
হয়ে লড়েছে ‘দেরাদুন’ এ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই তিব্বতি গেরিলারা।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই তিব্বতিরা শুরু করেছিল তাদের
নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই। এ ছিল তিব্বতে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা লড়াই।
একসময় তাদের ধর্মগুরু দালাইলামার সাথে দলবলসহ ভারতে আশ্রয় নেয় এই
গেরিলারা। চীনের বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে লাড়াই করার করার জন্যই মূলত গঠিত হয়
এই রেজিমেন্ট- স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। কূটনৈতিকভাবে চীন-ভারত যুদ্ধ
দ্রুত শেষ হয়ে গেলে মাতৃভূমির দখলদারদের বিরুদ্ধে আর লড়তে হয়নি তিব্বতিদের।
এই গেরিলা বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ নেতা দাপোন রাতুক নগোয়ান এর অতি
সম্প্রতি প্রকাশিত স্মৃতিকথায় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
যুদ্ধের ইতিহাসও। তখন রাতুক নগোয়ানের পদবি ছিল তিব্বতি ভাষায় ‘দাপোন’, যার
ইংরেজি অর্থ ব্রিগেডিয়ার।
ব্রিগেডিয়ার রাতুকের লেখা থেকে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের
সীমান্তবর্তী মিজোরামের দেমাগিরি ঘাঁটিতে মোতায়েন হবার পর তিব্বতি
কমান্ডোরা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়- প্রথম ও প্রধান লড়াইটা করেছে মিজো
গেরিলাদের বিরুদ্ধেই। চীনের শাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভূমি তিব্বতের অধিকার
আদায়ের লড়াই করার জন্যই ভারতের সহযোগিতা নিয়েছিলেন রাতুক আর সহকর্মীরা।
কিন্তু ভারতের হয়ে তাদের এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথমেই লড়তে হলো, যে মিজো
যোদ্ধারাও লড়ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিব্বতি গেরিলাদের বিজয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধে এসএফএফ ব্যবহার করে বুলগেরিয়ান একে ফর্টিসেভেন এসল্ট
রাইফেল আর ছুরি যাতে ভারতীয়দের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি পাকিরা বুঝতে না
পারে। সাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্নতা রাখতে তাদেরকে চারটি এমআই ফোর
হেলিকপ্টার বরাদ্দ দেয়া হয়। তিব্বতীরা দুর্গম জঙ্গল আর পাহাড়ে একের পর
অভিযান চালিয়ে এক পাকিস্তানী চৌকি দখলে আনে। তবে তারা হারায় তাদের একজন
সদস্য কমান্ডার দীপন ধন্দুপকে, যুদ্ধের শুরুতেই তিনি নিহত হন শত্রুর
গুলিতে।
মূলত তিব্বতি বাহিনী প্রবেশ করে মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে, প্রথমেই লক্ষ্য
ছিল পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলো এবং ধীরে ধীরে ওগুলো জয় করতে শুরু করে। পার্বত্য
এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ হয় প্রচুর, পাক বাহিনীকে ঠেকাতে বিভিন্ন সেতু ধ্বংস
করার কাজটি করে এই তিব্বতি বাহিনী। একসময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র এবং
কাপ্তাই বাঁধেও আক্রমণ করে। যুদ্ধের শেষদিকে পাকবাহিনীর ৯৭ ব্রিগেড ও
দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন পার্বত্যাঞ্চল দিয়ে বার্মার দিকে পিছু হটতে
চাইলে তিব্বতি বাহিনী সাফল্যের সঙ্গে তাদের প্রতিরোধ করে।
কাপ্তাই বাঁধ ধ্বংস, পার্বত্য চট্টগ্রামকে মিজোদের দখল থেকে মুক্ত করাসহ
চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য যুদ্ধের অনুকুল
পরিবেশ তৈরির সেই মিশন অত্যন্ত সফলভাবেই সম্পন্ন করে এসএফএফ। একাত্তরের
বিজয়ের দিনটিতেও পাক বাহিনীরা যখন আত্মসমর্পণ করছে তখন চট্টগ্রাম বন্দর
থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলো তিব্বতী এই পাহাড়ি যোদ্ধারা।
ঠিক তার আগে দোহাজারী ব্রিজ ধ্বংস ও দখল করে পাকিস্তানীদের বার্মায়
পালানোর পথ রুদ্ধ করে দেয় তারা। শত্রুমুক্ত চট্টগ্রামে প্রটোকল ভেঙ্গেই
কুচকাওয়াজ করে এসএফএফ। এরপর তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এসএফএফ এর মোট ৫৬ জন বীর যোদ্ধা শহীদ হয়।
বিগ্রেডিয়ার রাতুকের স্মৃতিকথা ছাড়াও এসএফএফ এর আনুষ্ঠানিক কমান্ডার
জেনারেল এসএস উবান-এর “দি ফ্যান্টমস অফ চিটাগং: ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ” বই
থেকেও যোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায় ।
আমাদের মুক্তির যুদ্ধে অভূতপুর্ব আবদান রাখে এই এসএফএফ। কিন্তু তাদের এই
সক্রিয় অংশগ্রহণের ইতিহাস এখনো স্বীকৃত হয়নি তেমনভাবে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে
আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ, কিন্তু তিব্বতিরা আজও ভারতে ‘আশ্রিত’ই রয়ে
গেছে। ওদের কোন স্বাধীন ভূখণ্ড নেই, যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য
ভারতেও মেলেনি কোনো স্বীকৃতি এ দেশহীন মানুষগুলোর।
সূত্রঃ দেশে বিদেশে
ডা. রাম বরণ যাদব, নেপাল
নেপালের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডা. রাম বরণ যাদব ১৯৪৮ সালের ৪ঠা
ফেব্রুয়ারী নেপালের ধানুসা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক।
নেপাল বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। অন্যান্য দেশের মত নেপালও আকৃতিম
বন্ধুর মত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। ১৯৭২
সালের ১৬ই জানুয়ারী নেপাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ডা. রাম বরণ যাদব একাত্তরে কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেই সময়ে
তিনি কলকাতায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা
সেবা প্রদান করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী
কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা বন্ধে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সহযোগিতার জন্য ভারতের
সঙ্গে কাজ করেন।
নেপালি গুর্খা ও কৈরালা ভাতৃদয়ের (নেপালি কংগ্রেস) অবদান
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা অনস্বীকার্য, সেইসাথে আমাদের
পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের জনগণেরও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল এ কথা ভুলে গেলে
চলবে না। নেপালিরা দু ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে। প্রথমত-
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত গুর্খা রেজিমেন্টও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
এই গুর্খরা হল নেপালি। নেপালের মধ্য অঞ্চলের তামাং, মগর, রাই এবং লিম্বু
জাতিগোষ্ঠীই মূলত গুর্খা। মুক্তিযুদ্ধে এই গুর্খা বাহিনীর ছিল অসামান্য
অবদান। দ্বিতীয়ত- নেপালি কংগ্রেস। নেপালি কংগ্রেসের প্রসঙ্গ আসলেই প্রথমে
যে পরিবারের নামটি মনে আসে সেটি হল কৈরালা পরিবার। একাত্তরে কৈরালা
পরিবারের দুই ভাই বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা ও গিরিজা প্রসাদ কৈরালা নেপালি
রাজা কর্তৃক ক্ষমতা দখলের কারণে ভারতে নির্বাসিত ছিলেন। ভারতে বসেই তারা
নেপালে গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন
এবং সেই লক্ষ্যে অস্ত্র মজুদ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় নেতা জয়
প্রকাশ নারায়নের আহবানে সাড়া দিয়ে নেপালি কংগ্রেস তাদের সংগ্রহকৃত
অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেন।
রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক, ভুটান
পাহাড় পর্বত আর সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
ছোট্ট একটি দেশ- ভুটান। হিমালয়ের প্রাণ জুড়ানো শীতল জলধারা সেখানকার
মানুষের মন থেকে মুছে দিয়েছে সমস্ত পঙ্কিলতা। সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত এই
মানুষগুলো ভীষণ শান্তিপ্রিয়। একাত্তরে এই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো আমাদের
শান্তির জন্য পাশে এসে দাড়িয়েছিল। ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি
ওয়াংচুক মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের নিরীহ অসহায় মানুষের পাশে ছিলেন এবং
অর্থনৈতিক ও সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ
অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর)
প্রদান করা হয়।
সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, ভারত
১৯২০ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুন্সীগঞ্জ জেলার হাসাড়া গ্রামে
জন্মগ্রহন করেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়।
রাজনৈতিক মহলে তিনি সবার কাছে ‘মানুদা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। একাত্তরে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে ভারতের শিক্ষা ও যুব
কল্যাণমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাক করার জন্য বিশেষ
দায়িত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য বহির্বিশ্বের
বিভিন্ন দেশে প্রেরন করেন যার মধ্যে ছিল থাইল্যান্ড, হংকং, মালয়েশিয়া,
সিঙ্গাপুর জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।
চলবে....
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-২)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৩)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৪)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৫)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৬)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৭)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৮)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৯)