ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১)

পর্ব উৎসর্গঃ অনিমেষ রহমান

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের অবদান সুধীজন মহলে মোটামোটি সবারই জানা। এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ব্লগ ও প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে এবং এই মহান কাজে অনেক বিজ্ঞ লেখকের মূল্যবান লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। সে হিসেবে আমার মত একজন আনাড়ি মানুষের লেখায় হয়ত কোন নতুনত্ব থাকবে না কিংবা এ লেখা অনেকেরই ভাল নাও লাগতে পারে। তবুও এ বিষয়টি নিয়ে লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। লেখায় কোন ভুল ভ্রান্তি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা কিংবা জানানোর জন্য অনুরোধ থাকলো।    

একটি দেশ, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সবারই কাম্য। কোন কোন জাতিকে সেই স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন করতে অনেক বেশী মূল্য দিতে হয়। একটি যুদ্ধ কেড়ে নেয় অনেক কিছুই। কেড়ে নেয় লক্ষ বুকের তাজা রক্ত, বেঁচে থাকার অবলম্বন, ভিটেমাটি, নববধূর সোনালী স্বপ্ন, আশা, ভালবাসা। সব হারানোই বেদনার। অনেক হারানোর বেদনা নিয়ে একটি জাতি ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠে। বেদনার ধুসর জগতে তৈরী হওয়া ক্ষত একটু একটু করে বাড়ে। কোন কোন পিতৃহারা সন্তান তিল তিল করে বেড়ে ওঠে সেই ক্ষত বুকে নিয়েই, ক্ষত হয়তো একদিন শুকিয়েও যায় কিন্তু তার দাগটা থেকে যায় চিরস্থায়ীভাবে।

একজন মুক্তিযুদ্ধা যুদ্ধে যায় দেশ মাতৃকার টানে, শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে, দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে। একজন সৈনিক যুদ্ধ করে নিজের দেশের প্রতি কর্তব্যের কারণে কিন্তু একজন ভিনদেশী! সে কেন অন্য দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? সে কোন অচেনা অজানা মানুষের হাহাকার শুনে নিজের জীবন বিপন্ন করবে? এখানে তো তার কোন দায়বদ্ধতা নেই!

কোন কোন মানুষ থাকেন যাদের কোন ভৌগলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করে রাখা যায় না। কেউ কেউ দেশ কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে যান অবলীলায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদেরকে সামিল করেন জনমানুষের কাতারে। রুখে দাঁড়ান সব অনিয়মের বিরুদ্ধে। কখনো গর্জে ওঠে তাদের হাতিয়ার, কখনো কলম, কণ্ঠ, আবার কখনো বা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েন জীবন বিপন্ন করে। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা যে খুব বেশী তা কিন্তু নয়, বরং সংখ্যায় এরা খুবই কম কিন্তু যারা সবকিছুর উর্ধে উঠে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন তারাই হয়ে ওঠেন স্মরণীয়, কর্ম দিয়ে নিজেদেরকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম এ রকম কিছু স্মরণীয় সুহৃদকে যারা দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে আমাদের সেই মহাক্রান্তিকালে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত।

৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের সাথে মিশে আছে ভিনদেশী কিছু বন্ধুর নাম। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি আমাদের বিদেশী বন্ধুরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের কেউ কেউ কূটনীতিক হিসেবে, কেউ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, কেউ সাংবাদিক হিসেবে আবার কেউ কেউ লড়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ সমরে। এদেশের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই সব স্মরণীয় বরনীয় মানুষদের যারা আমাদের আকাশে আজও উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করছেন। এ রকম কয়েকজন স্মরণীয় বরনীয় মানুষকে নিয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা-


ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা বিদেশীদের মধ্যে বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সমরে অংশগ্রহন করার জন্য এই খেতাবে ভূষিত হন তিনি। টঙ্গীস্থ বাটা সু কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চাকরির সুবাদে এবং একজন বিদেশী হিসেবে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা ছিল বেশ, ফলে সব মহলেই বিশেষ করে সেনাসদরে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। অনেক সময় সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহনের সুযোগ পান।

মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য ও আর্থিক সহায়তা ছাড়াও পাক সেনাদের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগে তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা, তৎপরতা ও সব ধরনের গোপন তথ্য পাঠিয়ে দিতেন ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। সেইসাথে বাটা সু কোম্পানীর কারখানা প্রাঙ্গনসহ টঙ্গীর বেশ কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দেয়া সহ অস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা সামগ্রী ও আর্থিক সহয়তাও প্রদান করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কারখানায় আশ্রয় নিয়ে আশেপাশে গেরিলা অপারেশন চালাতো। শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের সহায়তায় পাক বাহিনী কর্তৃক বাঙ্গালীদের উপর নৃশংস নির্যাতন ও গনহত্যার চিত্র গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন গনমাধ্যমে পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ায় অসামান্য অবদান রাখেন।   

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য অবদানের কারণে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্বভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এই বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা।

 
পন্ডিত রবি শংকর

 

পন্ডিত রবি শঙ্কর তেমনই একটি নাম, সঙ্গীতের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন, হয়েছিলেন সব মহলেই বরনীয়, স্মরনীয়। রবি শংকর নামটি মনে হলেই সবার মনে প্রথম যে রূপটি চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেটি হল বিখ্যাত সেতার বাদক। এই পরিচয়ের বাহিরেও আমাদের কাছে তার আরেকটি বড় পরিচয় আছে, সেটি হল তিনি একজন বাঙালী ছিলেন। তার বাঙ্গালী পরিচয়ের সবচেয়ে বড় প্রমাণটি আমরা পাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধে অসহায় মানুষের কান্নার ধ্বনি তার মনকে ব্যাকুল করে তোলে। এই অসহায় মানুষগুলির পাশে তিনি শুধু একাই দাঁড়াননি, যুক্ত করেছিলেন বন্ধু আমেরিকার বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের উজ্জ্বল নক্ষত্র জর্জ হ্যারিসনকে। তাকে অনুরোধ করলেন বাংলাদেশের অসহায় মানুষের সাহাযার্থে এগিয়ে আসার জন্য। তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে জর্জ হ্যারিসন রচনা করেন সেই বিখ্যাত গান বাংলাদেশ যা গাওয়া হয়েছিল ১লা আগস্ট সেই নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। রবি শঙ্করের সেতার আর হ্যারিসনের গাওয়া বাংলাদেশ গানটি বাংলাদেশের অসহায় মানুষের কান্নার রোলকে পৌছে দিয়েছিল বিশ্বের দরবারে, নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব বিবেক। ১১ই ডিসেম্বর ২০১২ চিরবিদায় নেন এই মহান ব্যক্তিত্ব।        


আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ

Millions of daughters walk in the mud
Millions of children wash in the flood
A Million girls vomit & groan
Millions of families hopeless alone

কিছু শব্দ। একটি কবিতা। একটি ইতিহাস, মানবতার ইতিহাস। একটি কবিতা যে কতখানি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে তার একটি প্রমাণ গিন্সবার্গ। আমাদের মুক্তির সংগ্রামে মার্কিন সরকারের অবস্থান ছিল আমাদের বিপক্ষে কিন্তু সে দেশের নাগরিক গিন্সবার্গ নিজ দেশের সরকারের বিপক্ষাবলম্বন সত্বেও এগিয়ে এসেছিলেন এ দেশের দুর্ভাগ্যকবলিত অসহায় মানুষের সাহার্যার্থে। যুদ্ধকালীন সময় হাজার হাজার শরনার্থী আশ্রয় নিয়েছিল সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং সীমান্তের ওপারের পশ্চিমবঙ্গে। গিন্সবার্গ সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের বাড়িতে এসে ওঠেন, পরবর্তীতে সুনীলের সাথে পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে নৌকায় করে পৌছান বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরে। ওখানকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের চরম দুর্দশা দেখে করে নির্বাক হয়ে পড়েন। এই হতভাগ্য মানুষের মানবেতর অবস্থাকে তুলে ধরেন তার অমর কাব্য ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ এর মাধ্যমে।

পরবর্তীতে দেশে ফিরে গিয়ে বন্ধু বব ডিলানকে নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কে রূপ দেন গানে। আয়োজন করেন কনসার্টের এবং কনসার্টে আয়ের সম্পুর্ন অর্থ দান করেন বাংলাদেশী শরনার্থীদের সাহাযার্থে। 

শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দুধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল

কোলকাতার শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক পরে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কে বাংলা রূপ দিয়ে গেয়েছেন যশোর রোডশিরোনামে, যে গানটিও বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।


জর্জ হ্যারিসন

১লা আগস্ট, ১৯৭১। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কায়ার গার্ডেন, আয়োজন চলছে একটি কনসার্টের। না, নিছক আনন্দের জন্য নয় এই কনসার্ট। এই প্রথম তারকা শিল্পীর উপস্থিতিতে মানবতার কল্যাণে  কনসার্ট। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। সমবেত হাজার হাজার জনতার সামনে গিটার হাতে স্টেজে এলেন বিটলসের জাদুকর জর্জ হ্যারিসন। তার কন্ঠে উচ্চারিত হল- বাংলাদেশ বাংলাদেশ, হোয়ার সো ম্যানি পিপল আর ডায়িং ফাস্ট... আই হ্যাভ নেভার সীন সাছ ডিস্ট্রেস... জেনে যায় বিশ্ববাসী, রচিত হয় মানবতার জয়গান। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী নিজ দেশের সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বন্ধু পন্ডিত রবি শঙ্করের আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি।

হাজার মাইল দুরত্ব, একটি অচেনা দেশ, অচেনা জাতি, সবকিছু উপেক্ষা করে শুধুমাত্র অসহায় মানুষের মৃত্যু, কান্না, আর্তনাদকে উপলব্দি করে রচনা করলেন সেই অমর গান। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষার জন্য সেদিন শুধু নিজেই এগিয়ে আসেননি যুক্ত করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত লিয়ন রাসেল, বিলি প্রিস্টন, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপ্টন, রিঙ্গো স্টারের মত শিল্পীদের। সেদিনের সেই কনসার্টের প্রাপ্ত দুই লক্ষাধিক মার্কিন ডলার তিনি দান করেছিলেন বাংলাদেশের শরনার্থীদের। ২৯শে নভেম্বর, ২০০১। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন আমাদের এই অকৃত্রিম  বন্ধু।


চলবে.......

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 29/06/2013
সর্বমোট 7528 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ