ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ড. আইনুন নিশাত সাহেব নিজেই ‘বঙ্গবন্ধু’র উক্তি “বানিয়ে” নিয়েছেন! কিন্তু কেন? জানেন?



ড. আইনুন নিশাত সাহেব নিজেই ‘বঙ্গবন্ধু’র উক্তি “বানিয়ে” নিয়েছেন! কিন্তু কেন? জানেন?

সাইয়িদ রফিকুল হক

 
গত পহেলা এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ফেসবুকে একটা বক্তব্য ভাইরাল হলো। এই বক্তব্যটি প্রদান করেছেন বিশিষ্ট প্রকৌশলী ড. আইনুন নিশাত সাহেব। তার এই বক্তব্যটি হলো:
 
“দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের রাজনীতি ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য অধ্যাদেশের খসড়া যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন যে এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না।”
 
বক্তব্যটি সঙ্গে-সঙ্গে ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ‘হুজুগে বাঙালি’ একটা জিনিস একবার পেলে আর রক্ষা নেই। সেটা সমানে খেতে থাকে। যাচাই নেই বাছাই নেই। চোখ বুঁজে “শেয়ার” করতে আর “বলতে” পারলেই হলো। হয়েছেও তা-ই। যে যেমনে পেরেছে তার এই কথাটা ছড়িয়ে দিয়েছে অনলাইনে। কোনোরকম পরীক্ষানিরীক্ষা আর চিন্তাভাবনা ছাড়াই উপর্যুক্ত কথাটি ‘বঙ্গবন্ধু’র নামে চালানো হয়েছে। কারও নিজের বানানো ও মনগড়া কথা ‘বঙ্গবন্ধু’র কথা হয় কীভাবে?
 
বক্তব্যটি দেখার সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে চতুর্বিধ প্রশ্ন জাগে:
 
প্রথমত; ‘বঙ্গবন্ধু’র মতো বড়মাপের নেতা কখনোই বলতে পারেন না, “এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না।” তার মানে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নষ্ট করা যাবে! কী রকম ভয়াবহ ও আজগুবি কথা! এটা ‘বঙ্গবন্ধু’র রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে ভয়ানক সাংঘর্ষিক। তাঁর কাছে বাংলার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমান ও আদরের। কারণ, তিনি বাঙালি জাতির জনক। আর পিতা কখনোই পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন না। এ-কথার আরও অর্থ হয় যে, এই দুটো প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সব খারাপ! তাই, এগুলো নষ্ট হলে কোনো সমস্যা নেই! কতবড় ভয়াবহ কথা! এটা কখনোই বঙ্গবন্ধু বলেননি।
দ্বিতীয়ত; স্বাধীনতার পর-পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক মনগড়া কথাবার্তা বলা হয়েছে। আর এগুলো করেছে তাঁর বিরোধীপক্ষ—বামপন্থীদের একাংশ ও ডানপন্থীদের (পাকিস্তানপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সেবাদাসগং) সমগ্র।
তৃতীয়ত; হ্যাঁ, এরকম কথা কেউ শুনতে পারেন। যদি তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’র খুব কাছের লোক হয়ে থাকেন তাহলে। তার কারণ, ‘বঙ্গবন্ধু’র কাছের লোকেরা সবসময় তাঁর কাছে যাতায়াত করতেন। আর তাদের কাছে কোনো-এক-সময় ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়তো কথায়-কথায় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো-একটা কথা আন-অফিসিয়ালি বলতে পারেন। তাই বলে এমন স্বজনপ্রীতির, পক্ষপাতদুষ্ট ও সাংঘর্ষিক কোনো কথা নয়।
চতুর্থত; আইনুন নিশাত সাহেবরা কখনোই ‘ছাত্রলীগে’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কখনোই ‘ছাত্রলীগ’ করেননি। তারা করেছেন হয়তো করেছেন ছাত্র ইউনিয়ন। আর ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা ‘বঙ্গবন্ধু’কে সহ্য করতে পারতো না। সারাক্ষণ তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত থাকতো। তাই, এইধরনের মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু’র কাছে কখনোই যাননি। তিনি কীভাবে এ-ধরনের কথা ‘বঙ্গবন্ধু’র মুখ থেকে শুনবেন?
 
আমি শুরু থেকেই আইনুন নিশাত সাহেবের কথাটা একদম বিশ্বাস করতে পারিনি। ফেসবুকে দেখেছি। এমনকি আমাদের ব্লগেও ওই কথাটি নিয়ে একটা পোস্টও দেখেছি। তারপরও তা বিশ্বাস করিনি। বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বাসযোগ্য কথা মনে হয়নি। কথাটির চেহারাসুরত আমার কাছে আগাগোড়া “বানোয়াট ও ভিত্তিহীন” বলে মনে হয়েছিল। আর এখনও তা-ই। তাই, আমি উপযুক্ত প্রমাণ খুঁজতে লেগে গেলাম।
বিশ্বাস করুন, খবরটি দেখার পর থেকেই আমার মাথায় একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো যে, ‘বঙ্গবন্ধু’ এমন একটা কথা কবে-কোথায় বলেছেন? তার তো রেফারেন্স থাকতে হবে।
গুগলে খুঁজে কোনো তথ্য পেলাম না। অনেকের কাছে রেফারেন্স চেয়েছি। পাইনি! আইনুন সাহেবের এই কথার রেফারেন্স কেউ দেখাতে পারেননি। এমনকি আইনুন সাহেব নিজেও দেখাতে পারবেন না। কারণ, এমন কথা ‘বঙ্গবন্ধু’ কখনোই বলেননি।
 
আমার চ্যালেঞ্জ: কেউ যদি আইনুন সাহেবের কথার সপক্ষে একটি রেফারেন্স বা প্রমাণ দেখাতে পারেন—তাহলে, আমি সঙ্গে-সঙ্গে দুঃখপ্রকাশ করে এই পোস্টটি সরিয়ে নিবো।
 
আইনুন সাহেবের এই কথার ওপর আমার বিশ্বাস নেই। তাই, আমার ঘুম নেই।
পরদিন আমার এক নামকরা ব্যারিস্টার আপাকে (উনার নাম নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সবাই চিনতে পারবেন। প্রয়োজন হলে উনার নাম জানাতে পারবো) জানালাম, “আপা, এইটা একটু দেখেন।” উনি তখনও হয়তো এটা দেখেননি।
উনি ওটা দেখে সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে বললেন, “লিংক দে।”
আমি বললাম, “লিংক ওই বক্তব্যের উপরে দেওয়া আছে।”
তারপরও বললাম, “ডেইলি স্টার বাংলা অনলাইন পহেলা এপ্রিলের পত্রিকা এটা।”
উনি সঙ্গে-সঙ্গে কাজে লেগে পড়লেন।
একটু পরে বললেন:
 
আইনুন নিশাত স্যারের গল্পের সূত্র পাওয়া মুশকিল। ব্র্যাকে আমি যখন ছিলাম, তখন উনাকে ভিসি হিসেবে পেয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বললাম।
 
তার মানে উনি গল্প বলতে ও নিজের প্রয়োজনে গল্প বানাতে ভালোবাসেন।
 
উনি (আমার সেই ব্যারিস্টার আপা) নিজেও খুঁজে কোনো রেফারেন্স পেলেন না। এমনকি আমার কথা শুনে উনি দেরি না-করে সঙ্গে-সঙ্গে ফেসবুকে নিশাত সাহেবের বক্তব্য দিয়ে একটা পোস্ট দিলেন। আর বললেন, “কেউ এই কথার কোনো রেফারেন্স জানলে দয়া করে জানাবেন।”
কিন্তু তাতেও কেউ সাড়া দিলো না। আজ অবধি দেয়নি।
 
আসলে, এই কথাটা ‘বঙ্গবন্ধু’ বলেননি। ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম-ব্যবহার করে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু করার বিরোধিতা করা হয়েছে। যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার কথা শুনে দুর্বল হয়ে পড়েন। আর বুয়েটে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা যায়। আর এটাও দেখাতে চেয়েছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু’ যেখানে এমন একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে গিয়েছেন সেখানে (বুয়েটে) রাজনীতি চালু করার প্রশ্নই আসে না! কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে রাজনীতি চালু করা হচ্ছে! তারপরও তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কথাও মানছেন না! মানেন না!
এই হলো আসল কেস। এই হলো হঠাৎ ‘বঙ্গবন্ধু’র নামে ভুয়া ও রেফারেন্স-বিহীন বক্তব্য প্রদানের প্রহসন। যারা জীবনে কখনোই দুই-একবার ‘বঙ্গবন্ধু’র নামও নেননি তারা হঠাৎ করে কেন ‘বঙ্গবন্ধু’র নামে এমন একটা কথা এইসময় ভাইরাল করলেন? কেন হঠাৎ ‘বঙ্গবন্ধু’র নামে এটা প্রচার করলেন? এখানে, মনে একটা ‘কিন্তু’ জাগে না?
 
এব্যাপারে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অভিমত প্রকাশ করেছেন:
 
“শিক্ষক রাজনীতি বলতে যেই বিষয়টি বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণই ছিলো ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষক রাজনীতির ইস্যু তুলে নিয়ে আসাটাই অযৌক্তিক। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে, বিশেষত তার নিজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিয়ে শুধু মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নষ্ট হওয়ার’ হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন এমন মন্তব্য কখনও কোথাও পাওয়া যায়নি। এটাও হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া গুজবগুলোর একটি যা বুয়েটে একটি পক্ষ প্রচার করেছেন। সেখান থেকেই শুনতে পারেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত।”
 
খবরটি তৈরি করেছে ‘দি ডেইলি স্টার’-এর বাংলা ভার্সন। এরা আজ পর্যন্ত সরকারের বিরোধিতা ছাড়া আর-কিছু করেনি। তাছাড়া, এই ডেইলি স্টার বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে! তাই, হঠাৎ করে অধ্যাপক আইনুন নিশাত সাহেবকে দিয়ে এমন একটা খবর প্রচারের মানে কী? কেউ জানেন? জানলে দয়া করে জানাবেন। আমার জানা আছে। কিন্তু এখনই সবটা বলার ও লেখার সময় আসেনি। এব্যাপারে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রয়েছি। আরও দেখবো। তারপর বিস্তারিত লিখবো।
 
কিন্তু একটা কথা অনায়াসে ও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বলা যায়। ড. আইনুন নিশাত সাহেব ‘বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে যে-কথা বলেছেন, সে-কথা তিনি নিজেই বলেছেন, “এটা তিনি শুনেছেন!” পাঠক, “শুনেছেন!” কিন্তু এর কোনো রেফারেন্স নেই। যা কোনো কাগজে, দৈনিক পত্রিকায় বা সরকারি ফাইলেও নেই!
 
আর-একটি কথা: নিজেদের প্রয়োজনে ‘ডেইলি স্টার’রা খবর বানিয়ে নেয়। তাদের প্রয়োজন হয়। এর আগে গতবছর ‘স্বাধীনতা দিবসে’র আগে ‘দৈনিক প্রথম আলো’র এক সাংবাদিক এক দরিদ্র কিশোরের হাতে “নগদ ১০ টাকা” ধরিয়ে দিয়ে তাকে বলতে বাধ্য করেছিল, আমরা এই স্বাধীনতা চাই না!!! আমগো মাছ-মংসের স্বাধীনতা চাই!!! পরে দৈনিক প্রথম আলো-কর্তৃপক্ষ নিজেদের ভুল স্বীকার না-করে ওই সাংবাদিকের ওপরে দোষ চাপিয়ে রেহাই পেয়েছিল। তাই, সাধু সাবধান!
 
প্রিয় সুধীসমাজ, এখানেই বিরাট একটা কিন্তু আছে! আজ এ-পর্যন্তই। পরবর্তীতে আবার দেখা হবে।
 
আবারও আমার সেই চ্যালেঞ্জ: কেউ যদি আইনুন সাহেবের কথার সপক্ষে একটি রেফারেন্স বা প্রমাণ দেখাতে পারেন—তাহলে, আমি সঙ্গে-সঙ্গে দুঃখপ্রকাশ করে এই পোস্ট সরিয়ে নিবো।
 
ছবি: ফেসবুক ও গুগল
 
 
তথ্যনির্দেশ:
 
দি ডেইলি স্টার বাংলা ভার্সন, এপ্রিল, ১।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা।
সুধীজনের মতামত। ফেসবুক ও গুগুলে তথ্য সার্চ।
সরকারের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’র এমন উক্তি স্বীকার করা হয়নি।
আওয়ামীলীগের কোনো প্রবীণ নেতাগণ:
(যেমন, জনাব তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আমীর হোসেন আমু,
ড. মহী উদ্দীন খান আলমগীর, নুহ-উল-আলম লেনিন প্রমুখ)।
তাঁরাও এই বক্তব্য স্বীকার করে কোনো বক্তব্য দেননি)।

লেখকের হাইপোথিসিস
 
 
 
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
০৩-০৪-২০২৪
 

ছবি
সেকশনঃ সাম্প্রতিক বিষয়
লিখেছেনঃ সাইয়িদ রফিকুল হক১ তারিখঃ 04/04/2024
সর্বমোট 314 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন