ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১৩)

পর্ব উৎসর্গঃ অপ্রিয় সত্য এবং সঞ্চয় সুমন

জোয়ান বায়েজ

JoanBaezHowSweettheSound.jpg

একাত্তর অনেককেই আলোড়িত করেছে। তৃতীয় বিশ্বের ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া শতাব্দীর অন্যতম নারকীয় তান্ডব অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছিল সেই সময়ে। সেই ভাবনাগুলোকে কেউ কেউ ফুটিয়ে তুলেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়, তুলে ধরেছেন বিশ্ব দরবারে। তেমনই একজন মানুষ বিখ্যাত মার্কিন ফোক গায়িকা এবং সমাজকর্মী জোয়ান বায়েজ। জন্ম ৯ই জানুয়ারী ১৯৪১ নিউইয়র্কের স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে। তিনি সংগীত জীবন শুরু করেন বোস্টন এবং ক্যামব্রিজের কফিহাউজগুলোতে গান গেয়ে, ১৯৫৯ সালে নিউপোর্ট ফোক উৎসবে অংশগ্রহণ করে খ্যাতি লাভ করেন।

উনিশ শ একাত্তর, তখন তাঁর বয়স ত্রিশ ছুঁয়েছে মাত্র। গীটার হাতে মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র আর ভরিয়ে তুলছেন তাঁর ভক্তদের মন। এ রকম একটি সময়ে তিনি তিনি জানতে পারেন আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া গনহত্যার খবর। মানবতার জন্য কেঁদে উঠলো তাঁর মন, তিনি এক অসামান্য গান গান বাধলেন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে।

একাত্তরের নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ যেখানে বিশ্বের নামকরা সঙ্গীত শিল্পীরা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য গেয়েছিলেন মানবতার গান। বিটলসের জর্জ হ্যারিসন গাইলেন তার সারা জাগানো সেই বাংলাদেশ বাংলাদেশ গানটি, সেই অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, বব ডিলানও। এ কনসার্টই জোয়ান বায়েজের গাওয়ার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে তার রচিত ‘স্টোরি অফ বাংলাদেশ’ নামক গানটি। কিন্তু তিনি গাইতে পেরেছিলেন কিনা জানা যায়নি, কোন কোন লেখা থেকে জানা যায় তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি সেই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন কিনা সেটা মুখ্য নয় কিন্তু তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে যে অসাধারণ গানটি তৈরি করেছিলেন তা মানুষকে একবার হলেও ভাবিয়েছিল মানবতার পক্ষে দাঁড়াবার জন্য। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট একাত্তরের ২৫শে মার্চের কালোরাত এবং ঢাকায় পাক সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘটানো হত্যাযজ্ঞ।

joan_baez+++.jpg

রক্তেগাঁথা বাংলাদেশের গল্প বলেছেন তিনি তাঁর সেই গানে। গানটিতে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অস্ত্র গর্জে উঠেছিল সেদিন, ইউনিভার্সিটিতে ঘুমন্ত সাধারণ ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছিল সৈন্যরা, শহরের আকাশ বাতাস কাপিয়ে গর্জে উঠেছিল মেশিনগান আর মর্টারের শব্দ। ঢাকার আনাচে কানাচে শোনা যাচ্ছিলো আর্তনাদের ধ্বনি। লাখো মানুষের মৃত্যুর খবরটি জোয়ানের সেই গানে যেন দারুনভাবে ফুটে উঠেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে এই গানটিই ‘সং অফ বাংলাদেশ’ নামে জোয়ানের একটি অ্যালবামে প্রকাশিত হয়।

joan-baez-song-of-bangladesh-am-records.jpg

দেখা যাক অসাধারণ সেই গানের কথাগুলি, যা সেইসময় বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল বাংলাদেশের অসহায়, নিপীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে-

SONG OF BANGLADESH

Bangladesh, Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
When the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh

The story of Bangladesh
Is an ancient one again made fresh
By blind men who carry out commands
Which flow out of the laws upon which nation stands
Which is to sacrifice a people for a land

Bangladesh, Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
When the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh

Once again we stand aside
And watch the families crucified
See a teenage mother’s vacant eyes
As she watches her feeble baby try
To fight the monsoon rains and the cholera flies

And the students at the university
Asleep at night quite peacefully
The soldiers came and shot them in their beds
And terror took the dorm awakening shrieks of dread
And silent frozen forms and pillows drenched in red

Bangladesh, Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
When the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh

Did you read about the army officer’s plea
For donor’s blood? It was given willingly
By boys who took the needles in their veins
And from their bodies every drop of blood was drained
No time to comprehend and there was little pain

And so the story of Bangladesh
Is an ancient one again made fresh
By all who carry out commands
Which flow out of the laws upon which nations stand
Which say to sacrifice a people for a land

Bangladesh, Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
When the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh

কালজয়ী সেই গানটি শুনতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

তিনি শুধু যে এই কালজয়ী গান রচনা করেন তাই নয়, মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত সেই কনসার্টের পর থেকেই জোয়ান শুরু করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং তহবিল সংগ্রহের। একের পর এক ফ্রি কনসার্ট করেন, যুদ্ধবিরোধী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে এভাবেই বাংলাদেশের মানুষের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি। এদেশের অসহায় মানুষের উপর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কথা, এই বর্বরোচিত গনহত্যার কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ান এই শান্তির দূত। আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মুহুর্ত পর্যন্ত তার এই নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।

কীথ ওয়াটারহাউস

Keith-Waterhouse-001.jpg

একাত্তরে লন্ডনের ডেইলি মিরর পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন কীথ ওয়াটারহাউস। ৯ই জুন ১৯৭১ বুধবার মিররের প্রথম পাতায় তিনি একটি কলাম লিখলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করলেন, কলামটি বৃহস্পতিবার প্রকাশ হবার কথা থাকলেও তিনি একদিন আগেই দিলেন কারণ এই একদিনই হয়ত অনেক মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে পারে। তিনি যা লিখলেন তা অনেকটা এরকম-

যোগাড় কর এক পাউন্ড

নষ্ট করার মত সময় নেই, এটি করুন বরং দুপুরের আগেই করুন।
যোগাড় করুন একটি খাম
কলমটি হাতে নিন, খামের উপর লিখুন-
SAVE A LIFE
BOX-189, DAILY MIRROR
1 THABIS IN LONDON

অনেকের হয়ত অন্য সাহায্য সংস্থা আছে কিংবা কেউ হয়ত সঠিক ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছেন না, আবার কেউ কেউ হয়ত ভাবছেন এই দানটি জায়গয়ামত যাচ্ছে তো! ঝেড়ে ফালুন সব সন্দেহ, তিন পেনির একটি টিকেট সেঁটে দিন খামের উপর, তারপর এক পাউন্ডের একটি নোট হাতে নিন। যদি নিজের কাছে না থাকে তবে ধার করুন, গ্যাসের জন্য জমানো টাকা থেকে নিন, বাড়ি ভাড়া থেকে নিন, বাচ্চার পকেট মানি থেকে নিন, তা না পেলে কিছু বিক্রি করুন কিংবা বন্ধক রাখুন। তারপর পোষ্ট করুন। ধন্যবাদের আশা করবেন না, কারণ এই ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতিতে আপনি খুবই ক্ষুদ্র অংশ সম্পন্ন করছেন।
কলামটি প্রকাশ হবার পর দুদিনের মধ্যেই জমা পড়েছিলো তেত্রিশ হাজার চারশ পাউন্ড!

জ্যাক প্রেমা

১৯৭১ সালে জ্যাক প্রেমা ছিলেন জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্টাটিজের পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসের সহ সভাপতি। তিনি রেডক্রসের ভুল সিদ্ধান্তগুলোর বিরোধিতা করতেন সব সময়। একাত্তরের এপ্রিল মাসে রেডক্রস বাঙালি শরনার্থীদের সাহায্য করার জন্য কিছু মেডিকেল সাপ্লাই নিয়ে পূর্ব ঘোষণা দিয়েই করাচী পৌছে এবং পাকিস্তান সরকার যাথারীতি সেই মেডিকেল সাপ্লাই আটকে দেয়। জ্যাক প্রেমা মনে করেন রেডক্রস যদি পূর্ব ঘোষণা ছাড়া গোপনে এই সাপ্লাইগুলো পাঠাতো তাহলে এগুলো শরনার্থীদের মাঝে পৌছানো যেত। তার মতামত গ্রহন না করে এবং শরনার্থীদের মাঝে ত্রাণ পৌছাতে না পারার প্রতিবাদে তিনি রেডক্রসের সহ সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন।

আজকের পর্বের তথ্যের জন্য কৃতজ্ঞতাঃ মুনতাসীর মামুন এর অন্যরকম যুদ্ধ, ব্লগার অভিজিৎ, উইকি।

চলবে.....

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১২)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১১)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১০)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৯)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৮)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৭)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৬)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৫)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৪)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৩)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-২)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১)

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 07/09/2013
সর্বমোট 2626 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ