ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

গান, সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ

 
এক।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে নিরীহ বাঙালী জাতির উপর বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হামলা ও গণহত্যা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সক্রিয় হয়েছিল স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র। কলকাতার বালিগঞ্জ স্ট্রিটের ৫৮ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রটি মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় রণাঙ্গনের মুক্তিসেনাদের প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের স্পৃহা যুগিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে, এটিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বাদশ সেক্টর বলা হয়।

এই বেতারকেন্দ্র শুধু পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করেনি, সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালির প্রাণের চাওয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্বের সমর্থন এবং সহযোগিতার আহ্বান‌ও জানিয়েছে। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক নাম ঘোষণা এক মুহূর্তে ধসিয়ে দিয়েছিল দাম্ভিক ইয়াহিয়ার প্রতিরোধহীন বিজয় দর্পকে। এই বেতার কেন্দ্র, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং শোকাভিভূত লাখো বাঙ্গালির মনে সঞ্চার করেছিল আশার আলো। এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র বহু বাঙালি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের, স্বস্তির, গৌরবের। বাঙ্গালি উঠে দাঁড়িয়েছিল গভীর আত্মবিশ্বাসে। বীর বঙ্গশার্দুলগণ পেয়েছিল শত্রুর ওপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সাথে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

দুই।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য পণ্ডিত রবিশংকর তাঁর শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটল্সের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বড় আকর্ষণ ছিলেন। গিটার বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু এই কনসার্ট এতো বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল যে, পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে একই দিনে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। এই কনসার্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়ে বিশ্বজনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

তিন।
দেশের যে-কোনো ক্রান্তিকালে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষণীয় ও অনস্বীকার্য। দেশীয় সাংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য জাতীয়-দিবসগুলিতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে থাকা শিল্পী-কলাকুশলীদের ভূমিকা প্রত্যক্ষ। বন্যা-খরা ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে দুর্গত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে শিল্পী সমাজ। দেশের বড় বড় সাফল্য উদযাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে শিল্পী সমাজ। দেশের সুস্থ ও টেকসই উন্নয়নে শিল্প-সংস্কৃতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিজের সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন না করে পৃথিবীর কোনো জাতি উন্নয়ন করতে পারেনি। আজও দেশের শিল্প-সাংস্কৃতিক অঙ্গন দৃশ্যমান কার্যকলাপের বাইরেও নীরবে-নিভৃতে সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। একটা দৃশ্যমান পদ্মাসেতুর উন্নয়নের থেকে এই অদৃশ্য ও নিরবধি উন্নয়নের ভূমিকা অনেক বেশি। দেশের সঙ্কটে নির্জীব সেতু বা সড়ক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না কিন্তু জীবিত সংস্কৃতির খোলা মনের মানুষ ভূমিকা রাখতে পারে। শুদ্ধ সংস্কৃতি শুদ্ধ ও যুক্তিবাদী মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। বাতাসের মধ্যে থেকে যেমন বাতাসের অস্তিত্ব বোঝা যায় না, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষগুলোর ভূমিকাও তেমনি। বিশুদ্ধ বাতাসের মতো এ অঙ্গনও প্রতিনিয়ত সমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তার শুদ্ধতা দিয়ে চলেছে।

শিল্প-সংস্কৃতির প্রয়োজন আছে বলেই এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত শিল্প-সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। আওয়ামী লীগের জয়বাংলা সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট; বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা আছে। এমনকি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামিরও বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র নামে একটি সংগঠন আছে। যদিও বিভিন্ন নামে জামায়াতের স্বপক্ষে প্রায় চারশো সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে যা গোপনে জামায়াতের সহায়তায় পরিচালিত হয়। এরমধ্যে কিছু সংগঠন আছে রেজিস্টার্ড কিন্তু অধিকাংশই নন-রেজিস্টার্ড। বিভিন্নভাবে এ সংগঠনগুলো জামায়াতের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উদীচী, ছায়ানটের মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। এছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট সংগঠন, গানের স্কুল ইত্যাদি আছে যাদের প্রতিনিয়ত ও নিরবধি ভূমিকা দেশের শিল্প-সংস্কৃতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে ভূমিকা রাখছে। সন্ত্রাসী সংগঠনের বিপরীতে এসব সংগঠন সুস্থ ও প্রমিত মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রেখে চলেছে।

চার।

অনেক বছর আগে একবার ঢাকার মিরপুরে ‘গমক’ নামে একটা গানের স্কুলে নিমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। ওখানে যারা নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল তারা সবাই ছিল মুক্তচিন্তার লেখক। গমক স্কুলে আমি সেদিন যে শুদ্ধ বাঙালিয়ানার চর্চা দেখেছিলাম তাতে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। হাঁটা, বসা, খাওয়া, সাজানো সবকিছুতেই নিরেট বাঙালিয়ানার পরম মমতা মেশানো ছাপ। ঢাকার এই ইট-পাথর-কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট নাম না জানা অখ্যাত প্রতিষ্ঠান যে চুপিসারে এমন শুদ্ধ বাঙালি চেতনা বিকাশে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে তা দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। সে ছাপ আজও আমার মনে গেঁথে আছে। স্কুলটি মূলত অলাভজনক। বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে শুদ্ধভাবে এগিয়ে নেবার প্রত্যয় থেকে এর প্রতিষ্ঠাতা শিল্প-সংস্কৃতির উপরে ভারত থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এ স্কুলটি চালু করেছিলেন। স্কুলে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। তাদের মন-মানসিকতা ও চর্চায় খাঁটি বাঙালিয়ানা। রীতিমতো মুগ্ধ হতে হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই শিশু। এদের থেকে যে সামান্য কন্ট্রিবিউশন আসে তাই থেকে স্কুলের খরচ চলে তবে তা অপর্যাপ্ত। এই সামান্য আয় থেকে শিক্ষকদেরও সামান্য কিছু সম্মানী দেওয়া হয়। আমি সেই যে একবার স্কুলটিতে গিয়েছিলাম আর যাওয়া হয়নি। তবে মনের মধ্যে সে প্রশান্তি আজও বহন করে চলেছি।

গত দুদিন আগে সেই ‘গমক’ স্কুলের একজন শিক্ষকের সাথে সামান্য কথা হলো। স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে। খবরটা শুনে আমার বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠল। চোখে পানি এসে গেল। একবার চোখে পানি এসেছিল স্কুলটির পরম যত্নে লালিত বাঙালিয়ানার শুদ্ধ চর্চা দেখে, এবার চোখে পানি এলো সে চর্চা বন্ধ হয়ে যাবার সংবাদ শুনে।

করোনা প্রকোপের সময়ে সরকার দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে অনুযায়ী এই স্কুলগুলিও তখন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেশের প্রচলিত স্কুলগুলি চালু হলেও এই স্কুলগুলি চালুর ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে শিথিলতা আনা হয়নি, ফলে আজ‌ পর্যন্ত স্কুলগুলো চালু হয়নি বলে জানিয়েছে স্কুল সংশ্লিষ্টরা। কেনো শিথিল করা হয়নি তা তারাও জানে না। এরকম খাঁড়া না কি এ ধরনের স্কুলগুলির জন্য এখনও দাঁড়া করে রাখা হয়েছে। এ কারণে এসব স্কুলের শিক্ষকগণ এবং সংশ্লিষ্ট মানুষগুলি কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ফলে নীরবে-নিভৃতে ধুঁকছে বাঙালিয়ানার চর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চায় পিছিয়ে পড়ছে আমার সোনার বাংলা। এসব স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাগণ তাঁদের সামান্য সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে চেষ্টা করছেন স্কুলগুলোকে চালু করতে কিন্তু বাস্তব সঙ্কটের তুলনায় তাদের সে প্রচেষ্টা ও সামর্থ খুবই অপর্যাপ্ত। কোনো পেশার পেশাদারগণ যদি ভালো না থাকে তবে সেই পেশাও ভালো থাকে না, রুগ্ন হয়ে যায়। এই রুগ্নতা গ্রাস করেছে গমকের মতো অগণিত স্কুলে কাজ করা অসংখ্য সাংস্কৃতিক মেধাকে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চর্চাকে পিছিয়ে দেবার জন্য কিছু অপ্রগতিশীল শক্তি সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে। এখানে সেই শক্তির আছর কাজ করছে কি না তা দেখা দরকার।

দেশ ও জাতিকে ধারণ করে এ বিষয়ে সরকার ও আগ্রহীগণ যদি এগিয়ে আসে তবে আমাদের সংস্কৃতির গতিশীলতা রক্ষা হয়। শুদ্ধ বাঙালী হবার এ পথ যতো সহজ হয় ততোই মঙ্গল। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এই মুক্তি মানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক মুক্তি। সাংস্কৃতিক চর্চা অবাধ না হলে এই মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 18/03/2023
সর্বমোট 1373 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন