ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-২)

পর্ব উৎসর্গঃ জটিল বাক্য

এডওয়ার্ড কেনেডি


টেড কেনেডি নামে পরিচিত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ এ ভারতে বাংলাদেশী শরনার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে তাদের অবর্ননীয় মানবেতর জীবন যাপনের করুণ চিত্র নিজ চোখে দেখেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের ভিসা না পেয়ে সেই শরনার্থীদের মুখেই শোনেন পাক বাহিনী কর্তৃক এদেশে নিশংস হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষন আর অমানষিক অত্যাচারের করুণ কাহিনী। ভারতের শরণার্থী শিবিরের মানুষের অবস্থা দেখে নিজ দেশে ফিরে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা উদ্ধৃত করে লন্ডন টাইমস লিখেছিল ‘এটা মানবজাতির জন্য আমাদের সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।‘ তিনি মার্কিন প্রসাসন যন্ত্রের অন্যতম অস্ত্র সিআইএ'র ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সিনেটে শরণার্থীবিষয়ক জুডিশিয়ারি সাব কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- পূর্ব পাকিস্তানে গনহত্যা চলছে, রেডক্রস আন্তর্জাতিক কমিটির প্রতিনিধিদের শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়ার জন্য যেন পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। পূর্ববাংলা ও ভারতের সংকট নিয়ে সিনেটর কংগ্রেসের যে সাত দফা সুপারিশ করেন তা ছিল নিম্নরূপ-

১. ইসলামাবাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতীকী নেতৃত্ব শেখ মুজিবের এই সংকটের যেকোনো রাজনৈতিক সমাধানে তার প্রতি ন্যায়বিচার ও তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার গুরুত্ব সর্বাধিক।
২. দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে খতিয়ে দেখতে হবে।
৩. দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করতে হবে।
৪. দক্ষিণ এশিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সাহায্যের পরিমাণ অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. স্টেট ডিপার্টমেন্টের আওতায় প্রেসিডেন্টকে একটি মানবিক ও সমাজসেবা ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬. জাতিসংঘের জরুরি সেবা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ সমর্থন জোগাতে হবে।
৭. পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডি অবশ্যই জাতিসংঘের সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে তা অন্তর্ভুক্তির বর্তমান প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্রের উত্সাহিত করতে হবে।

পাকিস্তানে কর্মরত রবার্ট জ্যাকশন ছিলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা নামের নিরীহ পদবীর আড়ালে কাউন্টার ইন্টেলেজেন্সী এক্সপার্ট। কেনেডি রবার্ট জ্যাকশন এবং পাকিস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস ফারল্যান্ডকে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত আনানোর জন্যও বিশেষ সুপারিশ করেন। এই দুজন ও তাদের টিম সুচারুভাবে কাজ করতে পারলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হত, মুক্তিযোদ্ধাদের কপালে জুটত আরও নৃশংসতা এবং মোট শহীদের সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়ত।


অ্যান্থনি মাসকারেনহাস

জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী, পেশায় সাংবাদিক। একাত্তরের এপ্রিল মাসে করাচীস্থ ‘দি মর্নিং সান’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে আরও কয়েকজনের সাথে কিছুদিন এদেশে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য ছিল তারা পুর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে সারা বিশ্বে ইতিবাচক সংবাদ প্রচার করবে যাতে বিশ্ববাসী এদেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে না পারে। অন্য সব সাংবাদিক তাদের ইচ্ছামত কাজ করলেও বাদ সাধলেন একজন, তিনি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস।
এ সময় তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন পাক বাহিনী কর্তৃক করা বর্বরতম হত্যাকান্ড তথা বাঙালী নিধনের নির্মম চিত্র। তার বিবেক সায় দেয়নি এইসব সত্য লুকিয়ে মিথ্যে সংবাদ প্রচারে। তাই ১৮ই মে এইসব গনহত্যার চিত্র সংগ্রহ করে পালিয়ে যান লন্ডনে। ১৩ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার প্রথম পাতায় পূর্ব পাকিস্তানের হনহত্যা নিয়ে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করে অন্তর্জাতিক অঙ্গনে হৈ চৈ ফেলে দেন। তার প্রকাশিত এই তথ্যাদি বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। তার হৃদয়ছোঁয়া রিপোর্টটি সারাবিশ্বের মানুষের অন্তরকে ব্যথিত করে। নড়েচড়ে বসে বিশ্ববোদ্ধারা, এরপর পুরো বিশ্ব বাংলাদেশকে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেনি। সেই রিপোর্টে ধীরে ধীরে উঠে এল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক করা বীভৎসতার চিত্র। একাত্তরের মার্চের শেষ দিক থেকে শুরু করে পাক বাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানী বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা, পঞ্চাশ লাখের মত মানুষের শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়া, কলেরা, দুর্ভিক্ষে অগণিত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার নারী ধর্ষনের কাহিনী, শিশুহত্যা- সব প্রকাশ হতে থাকলো। এই কর্মকান্ডের জন্য তার পরিবারকে লুকিয়ে থাকতেও হয়েছে, তবুও মায়ের নির্দেশ মত তিনি কখনো সত্য প্রকাশে পিছপা হননি। পরবর্তীতে তিনি তিনি The Rape of Bangladesh–1971 এবং Bangladesh: A Legacy of Blood-1986 নামক দু’টি গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গনহত্যা এবং পরবর্তী ঘটনাবলী তুলে ধরেন। ১৯৮৬ সনের ৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বিদায় নেন বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে পাশে দাঁড়ানো এই সুহৃদ।

সায়মন ড্রিং

সায়মন ড্রিং, বাংলাদেশীদের জন্য একটি পরিচিত নাম। একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরী করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন, নৃশংসতা ও গণহত্যার চিত্র। মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হতে দেখে সেদিন নির্লিপ্ত থাকতে পারেননি ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একটি পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের নরফোক এলাকায় জন্ম নেয়া সায়মন ড্রিং বাংলাদেশকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। সেই ভালবাসার প্রতিদানস্বরূপ বাংলাদেশের চরম ক্রান্তিলগ্নে তিনি দাড়িয়েছিলেন এদেশের মানুষের পাশে।
২৫শে মার্চের সেই কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার প্রাক্কালে ঢাকায় অবস্থানকারী সব বিদেশী সাংবাদিকদেরকে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বন্দী করে রাখে। পরদিন সবাইকে বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় বিমানে। উদ্দেশ্য ঢাকাকে বিদেশি সাংবাদিকশূন্য করা, যাতে এদেশে সংঘটিত গনহত্যার খবর বহির্বিশ্বে না পৌছায়। তাদের এই ষড়যন্ত্রে বাদ সাধে ২৫ বছরের এক টগবগে এই তরুণ সাংবাদিক, সামরিকজান্তার নির্দেশ অমান্য করে প্রাণের ঝুকি নিয়ে তিনি লুকিয়ে ছিলেন হোটেলে। পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে হোটেল কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরযানে করে ঘুরে বেড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা। ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র তুলে আনেন তিনি তাঁর প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন ৩০শে মার্চ ট্যাঙ্কস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান শিরোনামে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার এই প্রতিবেদনটি তখন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলে যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্কাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল। প্রতিবেদনের এক জায়গায় তিনি লেখেন- “আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের...”।
অবশ্য ঢাকায় আর বেশি দিন থাকতে পারেননি তিনি, ফিরে যেতে হয়েছে স্বদেশে। তবে ৭১ এর নভেম্বরে আবার আসেন ভারতে; ওখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠাতেন লন্ডনে। আমাদের বিজয় লগ্নেও আর দূরে থাকতে পারেননি বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু, তাইতো ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর সঙ্গে তিনিও চলে এসেছিলেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। ভাল থাকুন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই অমর সহযোদ্ধা।


জে এফ আর জ্যাকব

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে ভারতের লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব হচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক বড় সুহৃদ। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসাধারণ ভুমিকার কারণে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। একাত্তরে তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ, তখন তার পদমর্যাদা ছিল মেজর জেনারেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য আর এক্ষেত্রে জেনারেল জ্যাকবের বিশাল ভূমিকা ছিল। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর পুনর্গঠন, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র-রসদ জোগান দেয়াসহ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযানে এসে বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত জয়ে অসামান্য অবদান রাখে ভারতীয় বাহিনী। সর্বোপরি তার ভাষ্য থেকে জানা যায় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১এ জেনারেল নিয়াজীকে লজ্জাজনক এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন তিনি।

সিডনি শ্যানবার্গ


একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সব বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকার তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) বাধ্যতামূলকভাবে আটকে রাখে। সেই রাতেই ১১টার পর পাক সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক বাঙালি নাগরিকদের ওপর চালায় এক নারকীয় গণহত্যা । হোটেলে আবদ্ধ সাংবাদিকরা তাদের হোটেলের জানালা দিয়ে ট্যাঙ্ক এবং ভারী অস্ত্র সজ্জিত সেনাবাহিনীদের যেতে দেখেছেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন সবাইকে এক জায়গায় আটকে রাখার জন্য হন্যে হয়ে হোটেলে তল্লাশি চালাচ্ছিল, তখন তাদের ভেতর মাত্র দু'জন বিদেশী সাংবাদিক পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের একজন হলেন লন্ডনভিত্তিক ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং এবং অন্যজন ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গ।

সিডনি শ্যানবার্গ ১৯৩৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমেরিকার ক্লিনটন মাসাচুয়েটস এ জন্মগ্রহন করেন । তিনি পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য খন্ড খন্ড প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থী দের অবস্থা ।তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্ববাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ। সংকলনটির নাম ডেটলাইন বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান।

চলবে....

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 01/07/2013
সর্বমোট 4525 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ