ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ছন্দ: ছড়া, পদ্য, কবিতা (ছয়)

যাদেরকে উৎসর্গীকৃত: কবি ও ব্লগার স্বপ্নের কারিগর এবং শওকত আলী বেনু
 
মুক্ত ছন্দ বা নঞ ছন্দ
 
ছন্দবন্ধ কবিতার বাইরেও কবিতা হয়, এ যুক্তি ও বিশ্বাসকে ধারণ করে যারা নিজের লেখা কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলে বিবেচনা করেন তাদেরকেও বুঝতে হবে যে, যদি কোন লেখাকে কবিতা বলতেই হয় তবে সেখানে কোন না কোনভাবে কবিতার কোন না কোন চরিত্র উপস্থিত থাকতেই হবে। আপাতভাবে ছন্দহীন মনে হলেও প্রকৃতভাবে ছন্দ লুকায়িত আছে সেগুলিই মুক্তছন্দের মধ্যে পড়ে বলে আমার ধারণা।
 
বাংলা কবিতার ত্রিশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা অক্ষরবৃত্তের উপর প্রচুর কাজ করে একে একটা মুক্ত রূপ দিয়েছেন; যা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়মকে ঠিক রেখে পর্বে মাত্রা বাড়িয়ে-কমিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পর্ব ভেঙেচুরে ছন্দকে শাসন করে সজোরে আছাড় মেরে কবিতাকে সোজা করে দাঁড় করা হয়েছে। উঁকি দিয়েছে অক্ষরবৃত্তের নতুন ধারা। অক্ষরবৃত্তের এই নতুন রূপকে অনেকে “মুক্ত ছন্দ” বলেন। এই ছন্দকেই “নঞ ছন্দ” বলা হয়। নাই অর্থে নঞ। অর্থাৎ সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হয় কবিতায় ছন্দ নেই, কিন্তু বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে ছন্দের দৃঢ় বন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়।

নঞ ছন্দের উদাহরণ লক্ষ্য করা যাক:
 
১. আকাশ জানে না,/
প্রকাশ রাস্তায় একী/ কুড়ানো স্বাক্ষর,/
নক্ষত্র সমাজ খোঁজে/ শেষ পরিচয়/
ওরা পরস্পর/
নূতন বিরহে পায়/ অভিন্ন বিচ্ছেদে দীপ্তিময়/
উদ্ভাসিত দূরে দূরে/ অনন্ত বাসর।/
(যুগ্মদূর/ অমিয় চক্রবর্তী)
 
কাঠামো:
৬ মাত্রা
৮ মাত্রা + ৬ মাত্রা
৮ মাত্রা + ৬ মাত্রা
৬ মাত্রা
৮ মাত্রা + ১০ মাত্রা
৮ মাত্রা + ৬ মাত্রা
 
২. সজীব সকালে চোখ মেলি,/ প্রতিদিনের পৃথিবী/
আমাকে জানায় অভি/ বাদন। টাটকা রোদ
পাখিদের উড়াউড়ি,/ গাছের পাতার দুলুনি,/ বেলফুলের গন্ধ/
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে/
(একটি দুপুরের উপকথা / শামসুর রাহমান)

কাঠামো:
১০ মাত্রা + ৮ মাত্রা
৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা
৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা
১৪ মাত্রা
 
৩. যখন তাদের দেখি/ হঠাৎ আগুন লাগে/ চাষীদের মেয়েদের/
বিব্রত আঁচলে;/ সমস্ত শহর জুড়ে/ শুরু হয় খুন, লুঠ,/ সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা,/ গদ্যপদ্য;/ দাউদাউ পোড়ে/ পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে/ গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে/ ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল
আর্তনাদ করে বাঁশি/ যখন ওঠেন মঞ্চে/ রাজনীতিবিদগণ।
(রাজনীতিবিদগণ/ হুমায়ুন আজাদ)
 
কাঠামো:
৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা
৬ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ১০ মাত্রা
১০ মাত্রা + ৪ মাত্রা + ৬ মাত্রা + ৮ মাত্রা
৪ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ১০ মাত্রা
৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা + ৮ মাত্রা
 
এইসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে পর্বে মাত্রা সংখ্যা অসমান; কিন্তু সবগুলিতেই জোড় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়েছে।
 
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখাটা খানিকটা সহজ। যদিও এ ছন্দে কবিতা লিখতে গেলেও কতগুলি বিষয়কে মেনে চলা দরকার। যেমন-
 
১. অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়ম ঠিক রাখতে হবে।
২. প্রতিটি পর্বে জোড়সংখ্যক মাত্রা রাখতে হবে।
৩. পর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই থেকে শুরু করে চার, ছয়, আট, দশ যে কোনও সংখ্যক রাখা যেতে পারে।
 
মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সময় যদি একটা বিশেষ নীতি মেনে চলা হয় তবে উপরের তিনটি শর্তই একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব। নীতিটি হল:
 
জোড়ে জোড় এবং বিজোড়ে বিজোড় মাত্রায় কবিতা লেখা।
তার মানে জোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি জোড় মাত্রার শব্দ এবং বিজোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি বিজোড় মাত্রার শব্দ বসানো। এরপর ইচ্ছা মতো লাইন তৈরি করা হলেও ছন্দের কোনও বিচ্যুতি ঘটে না। (ক্রমশ…)
 
মূল উৎস: কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারি, ২০১১।

কৈফিয়ত: বাংলা একাডেমীর এ লেখাটি বহু ব্লগে হুবহু প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র হিসেবে এ জন্যে শুধু মূল উৎসের উল্লেখ করা হয়েছে, ব্লগের সূত্রগুলিকে উল্লেখ করা হয়নি। এটি আমার কোন মৌলিক লেখা নয়। বাংলা একাডেমীর লেখাটি থেকে সঙ্কলিত করে সহজতর করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
 

এই সিরিজ এর সব লেখা
ছবি
সেকশনঃ সাহিত্য
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 06/09/2014
সর্বমোট 14464 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন