ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

ছন্দ: ছড়া, পদ্য, কবিতা (৭ম ও শেষ পর্ব)

যাদেরকে উৎসর্গীকৃত: কবি সঞ্চয় সুমন, ব্লগার ও কবি নিভৃত স্বপ্নচারী এবং হলদে টিয়া

ছড়া:

কোন একজন বিখ্যাত ছড়াকার ছড়াকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘ছন্দ আর অন্ত্যমিলের প্রতি যত্নশীল হয়ে হালকা চালে সহজ শব্দের সমন্বয় সাধন করে বিষয়কে প্রকাশ করবার জন্যে যে পদ বা পদ সমষ্টির সৃষ্টি করা হয় তাকে ছড়া বলে।’ ছড়া সম্পর্কে অনেকেই অনেক মতামত ব্যক্ত করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে এ  সংজ্ঞাটিকে আমার পছন্দ।

ছড়া ছন্দ মেনে লিখতে হয়। এখানে অন্ত্যমিল থাকা বাঞ্ছনীয়। সহজ শব্দের সমন্বয় সাধন ছড়ার বৈশিষ্ট্য। ছড়া লিখতে গেলে পদে পদে মিল থাকাটা বেশ জরুরী। সাধারণত ছড়া হয় হাস্য রসাত্মক, শিক্ষামূলক, ব্যঙ্গার্থক। ছড়া মূলত লেখা হয় শিশুদের জন্য।

উদাহরণ:

‘সফদার ডাক্তার
মাথা ভরা টাক তার
খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে।
চেয়ারেতে রাত দিন
বসে গুনে দুই তিন
পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।’
[হোসনে আরা বেগম/ সফদার ডাক্তার]

অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়া সম্পর্কে বলছেন- ‘ছড়া যদি কৃত্রিম হয় তবে তা ছড়াই নয়, তা হালকা চালের পদ্য। তাতে বাহাদুরি থাকতে পারে, কারিগরি থাকতে পারে, কিন্তু তা আবহমানকাল প্রচলিত খাঁটি দেশজ ছড়ার সঙ্গে মিশ খায় না। মিশ খাওয়ানোটাই আমার লক্ষ্য। যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারি তবেই আমার ছড়া মিশ খাবে, নয়তো নয়।’

বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘আধুনিক কবির হাতে ছড়া বেরতে পারে শুধু এই শর্তে যে, তিনি বক্তব্য কিছু দেবেন, অথচ সেটুকুর বেশী দেবেন না যেটুকু এই হালকা ছোট চটুল শরীরে ধরে যায়। একেবারে সারাংশ কিছু না-থাকলে তা নেহাতই ছন্দের টুংটাং হয়ে পড়ে, মাত্রা একটু বেশী হলেও আর ছড়া থাকে না।’
 
পদ্য ও কবিতা:

সাহিত্যকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়: গদ্য, পদ্য ও নাটক। পদ্যের মধ্যেই পড়ে ছড়া ও  কবিতা। পদ্যের নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা পাওয়া যায় নি।

যুক্তিযুক্তর মতে- ‘পদ্য হল ছন্দমিলের দ্বারা মনের ভাব প্রকাশের একটি পদ্ধতি যা কতগুলো চরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে প্রতি চরণের দৈর্ঘ্য মোট চরণ সংখ্যার প্রস্থের থেকে কম হয় এবং এর দ্বারা মনের ভাবকে দুর্বোধ্য না করে প্রকাশ করা হয় ।’

পদ্যে ছন্দের মিল এবং লেখকের ভাবের সহজ প্রকাশ থাকাটাই জরুরি। কবিতা আর পদ্যে একটি বড় পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় এবং এই পার্থক্যই ‘কবিতা’ এবং ‘পদ্য’ কে আলাদা করেছে।
পার্থক্যগুলি সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক-

১. পদ্যে বিমূর্ত কিংবা রূপকের আশ্রয় নেওয়াটা একদমই জরুরী নয় কিন্তু আধুনিক কবিতায় এই বিষয়টি খুব বেশি প্রয়োজন।

২. কবিতায় প্রতিটি শব্দ ব্যাপক এবং গভীর অর্থে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ একই কবিতায়, একই শব্দের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতে পারে, ভিন্ন ভিন্ন ভাবের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু পদ্যের ভাষা অতি সহজ, সরল এবং বোধগম্য। কবি ঠিক যেমনটি বোঝাতে চেয়েছেন ঠিক ঠিক তেমনিভাবেই পাঠক বুঝে নিবে। অর্থাৎ নতুন করে অর্থভেদ করার প্রয়োজন পড়বে না। লেখকের আক্ষরিক ভাষা এবং মূল বক্তব্য একই হবে।

উদাহরণ:

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।’
[আমাদের ছোট নদী/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ একটি আদর্শ পদ্যের উদাহরণ। এই উদাহরণ থেকেই সহজে পদ্যকে কবিতা থেকে আলাদা করা যায়। উপরের লাইনগুলো একটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একটি সহজ সরল দৃশ্যকল্পের সৃষ্টি করেছে যা একটি গল্প বা উপন্যাসের মতোই ধারাবাহিক কাহিনী কিন্তু ছন্দে ছন্দে ঘটনার আবর্তণ।

কবিতার সাথে পদ্যের এ প্রচ্ছন্নতার পার্থক্যই মূল বিষয়।

উদাহরণ:
‘মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালোবাসা তোমার আমার।
নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে, কেবল তোমাকে।
বিরোধী নিধন শেষে কতোদিন অকারণে
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে দেখেছি তোমাকে বারবার কতোবার।’
[ অস্ত্র সমর্পণ/হেলাল হাফিজ ]

উপরের লাইনগুলো দিয়ে আক্ষরিক অর্থে কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু রূপক অর্থে কবি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণনা করে গেছেন ‘ভালোবাসা’ শব্দটি দিয়েই।

আধুনিক কবিতা সম্পর্কে অনেক গুণীজন অনেক রকম মতামত প্রদান করে গেছেন। সেগুলো বিশ্লেষণ করলে কবিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারণা চলে আসে এবং পদ্য ও কবিতার পার্থক্য নির্ণয় করা সহজ হয়। সেগুলির দিকে একবার নজর দেওয়া যাক।

ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ বলেছেন,’যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে,তার নাম কবিতা।’

বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘ কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে,স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না,‘বোঝানো’ যাবে না ।’

ম্যাকলিশ বলেছেন, ‘ কবিতা কিছু বোঝায় না; কবিতা হয়ে ওঠে।’

শেলী বলেছেন, ‘ কবিতা হল পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।’

বোদলেয়ার বলেছেন, ‘প্রত্যেক কবি অনিবার্যভাবেই সমালোচক। একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়া যতটা স্বাভাবিক তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হতে হবে যদি একজন কবির মধ্যে সমালোচক জেগে না থাকে।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতে ‘ রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।’

রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।’

জীবনানন্দ দাশের মতে, ‘উপমাই কবিতা।’

মালার্মে বলেছেন,’শব্দই কবিতা।’

সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞাটি মনে হয় দার্শনিক এরিস্টটল দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন,’ কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো।’

অন্যভাবে বলা যায়- “কবিতা ছন্দ মানে না বরং শব্দ দিয়ে হৃদয়ের ঘুমিয়ে থাকা ভাবকে ছন্দে পরিণত করে, যেখানে নিজের সাথেই কবি জাগিয়ে তোলেন পাঠককে।”  
 
মূল উৎস: কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারি, ২০১১।

কৈফিয়ত: বাংলা একাডেমীর এ লেখাটি বহু ব্লগে হুবহু প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র হিসেবে এ জন্যে শুধু মূল উৎসের উল্লেখ করা হয়েছে, ব্লগের সূত্রগুলিকে উল্লেখ করা হয়নি। এটি আমার কোন মৌলিক লেখা নয়। বাংলা একাডেমীর লেখাটি থেকে সঙ্কলিত করে সহজতর করার চেষ্টা করেছি মাত্র।

এই সিরিজ এর সব লেখা
ছবি
সেকশনঃ সাহিত্য
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 08/09/2014
সর্বমোট 49921 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ

সর্বোচ্চ মন্তব্যকৃত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সর্বোচ্চ পঠিত

এই তালিকায় একজন লেখকের সর্বোচ্চ ২ টি ও গত ৩ মাসের লেখা দেখানো হয়েছে। সব সময়ের সেরাগুলো দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন