ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৫)

পর্ব উৎসর্গঃ অমি রহমান পিয়াল

(যার লেখার সহায়তা না পেলে এই পর্বটা হয়ত লেখা হত না)

মারিও রয়ম্যান্স - লিমবার্গের থিল

mario roymance.jpg

ছেঁড়া জীর্ণ কাপড়ে কোনরকমে নিজের শরীর ঢেকে রাখা এক মায়ের কোলে একটি অপুষ্ট শিশু, চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে! কিংবা পথের পাশে পড়ে থাকা মানুষের লাশ ছিঁড়ে খুবলে খাচ্ছে কুকুর... অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে লোকজন দ্বিগবিদিক ছুটছে জীবন বাঁচাতে... সবারই লক্ষ্য সীমান্ত পার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে...

দৃশ্যগুলি মুহুর্তেই অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায়! দেখে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যান মারিও রয়ম্যান্স, মা-বাবা হারা বিশ বছরের এক বেলজিয়ান তরুণ। টেলিভিশনের নব ঘুরাতে ঘুরাতে ফ্লেমিশ এই তরুণ জানতে পারেন জায়গাটা পূর্ব পাকিস্তান যেখানে বিছিন্নতা দমনের নামে চলছে নির্বিচারে ভয়াবহ এক গণহত্যা। তরুণ মারিও বেশিক্ষণ আর এই দৃশ্য দেখতে পারলেন না, টিভি বন্ধ করে দিলেন কিন্তু মাথার মধ্যে টিভিতে দেখা দৃশ্যগুলো যেন ঘুরে ফিরে আসতেই থাকে, অসহায় মা-শিশু, প্রাণভয়ে ছুটতে থাকা মানুষের ছবিগুলো তার মনকে আলোড়িত করে ভীষণভাবে।

পরের দৃশ্যপট সম্পুর্ন ভিন্ন। এক সপ্তাহ পর লা সোয়েরে পত্রিকায় একটি ফোন আসে- আমি কিন্তু পেশাদার অপরাধী নই বরং শিল্পরসিক। বয়স মাত্র বিশ, একজন এতিম। মা বেঁচে থাকলে হয়তো এই কাজটা আমি করতাম না, কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ আমার সহ্য হয় না...

কথাগুলো ‘লিমবার্গের থিল’ নামে নিজেকে দাবী করা সেই বেলজিয়ান তরুণ মারিও রয়মান্সের। ১৯৭১, পুর্ব বাংলায় তখন চলছে ভয়াবহ মৃত্যু উৎসব, মৃত্যু-ধ্বংস-পলায়ন- এ যেন নিত্যদিনের চিত্র! সুদূর ব্রাসেলসে বসে টিভিতে এই দৃশ্যগুলো দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না এই তরুণ। ভয়ঙ্কর এই পরিকল্পনা ফাঁদলেন। তিনি যা করলেন বেলজিয়ামের ইতিহাসে আজ অবধি ঘটে যাওয়া সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকায় শীর্ষেই আছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি চুরি করলেন ১৭ দশকের শিল্পী ইয়োহান ভারমিয়ারের আঁকা ‘দ্য লাভ লেটার’ নামের মাস্টারপিসটি, যার মূল্য ছিলো ৫ মিলিয়ন ডলারের মত।

লা সয়েরে পত্রিকার একজন সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেনকে মারিও জানালেন- চুরি যাওয়া ভারমিয়ার এখন তার কাছে আছে এবং মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করলেন ২০০ মিলিয়ন ফ্রাংক যার মূল্যমান চার মিলিয়ন ডলার। সাথে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, টাকাটা তাকে নয়, পাঠিয়ে দিতে হবে ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিতাসের দপ্তরে। আর সেটা অবশ্যই ব্যয় করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের পেছনে! সেইসাথে হুমকি দেন- মুক্তিপণ ছাড়া পেইন্টিংটা উদ্ধারের চেষ্টা করা হলে এটা চিরতরে হারিয়ে যাবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তিনি সেটা বিক্রি করে দেবেন ল্যাটিন আমেরিকার এক ক্রেতার কাছে। আর সেইসাথে জাদুঘরে বাকি যে ৩৯টা ভারমিয়ার আছে, সেগুলোও চুরি করবেন।

লা সয়েরের কাছে খবর পেয়ে ডাচ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে ব্রাসেলসে আসে। পেইন্টিংটা সত্যিই আসল কিনা সেটা যাচাই করার জন্য তারা একজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে তা পরীক্ষা করার আবেদন জানায়। রাজি হয়না মারিও বরং দু’দিন পর ‘হেট ফক’ নামের আরেকটি পত্রিকায় টেলিফোন করেন তিনি এবং সময়সীমা বেধে দিয়ে বলেন-৬ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিপণ বাবদ ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পরিশোধ না করলে তিনি পেইন্টিংটি বিক্রি করে দেবেন বলে হুমকি দেন। শুধু তাই নয় সেই সাথে আরও কঠিন শর্ত আরোপ করে বলেন- পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য এই মুক্তিপণ পরিশোধের ঘটনাটা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। সেখানে চুক্তিপত্রে সই করার সময় ছবিটির বীমার দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ কোম্পানি গ্রায়েম মিলারকে উপস্থিত থাকতে হবে।

এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হয়না মারিওর। হ্যাসেটের যে পেট্রোলপাম্প থেকে ফোন করেছিলেন মারিও তার অপারেটর ঘটনাটি শুনে ফেলেন এবং পুরষ্কারের লোভে খবর দেন পুলিশকে। মপেডে চড়ে বেশীদূর যেতে পারেননি মারিও। ধাওয়ার মুখে আশ্রয় নেন এক গোয়ালে। লিমবার্গের রবিনহুডকে দুটো গরুর মাঝখানে গোবরের স্তুপে কয়েকটা খড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে পুলিশ।

বেলজিয়ামবাসীদের মধ্যে কিন্তু উল্টো প্রতিক্রিয়া ঘটে যখন লিমবার্গের থিলের গ্রেফতারের খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। তারা এই সহজ সরল তরুণের একটা মহৎ উদ্দেশ্যে এমন বেপরোয়া ও অভিনব উদ্যোগকে অপরাধ হিসেবে দেখতে রাজী হন না। বিভিন্ন মিডিয়া- সংবাদপত্রগুলো, রেডিও-টিভি তার পাশে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি যেখানে কাজ করতেন সেই হোটেলের মালিক-কর্মচারিরাও রাস্তায় নামেন মারিওর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে এবং পিটিশনে সাক্ষর সংগ্রহে। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে দাতব্য সংস্থাগুলো। থিল অব লিমবার্গের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেয় মারিওর আসল পরিচয়, জনতার আবেগ আর ভালবাসার কারণে প্রশাসন নরম হতে বাধ্য হয়। মাত্র দুই বছরের সাজা হয় মারিওর, কিন্তু ছয়মাস পরই মুক্তি পেয়ে যান তিনি।

জঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে

group.jpg

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের মানুষ বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। এরকম একজন মানুষ- জঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে। চিন্তা-চেতনায় বিচিত্রমুখী ফরাসি এই লেখক জীবনে নানাবিধ অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার কারণে। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর সদস্য, একসময় সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন কুখ্যাত ওএএসে নামক গোপন বাহিনীতে যারা আলজেরিয়াকে মনে করত ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আঁদ্রে মালরোর রচনা পড়ে বোধোদয় হয় পল ক্যুয়ে’র। তবে পুরোনো মতাদর্শের জের একেবারে কাটিয়ে উঠতে না পেরে স্পেন, লিবিয়া ও বায়াফ্রার বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিড়ে যান।

একাত্তর সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির খবর তাঁকে আলোড়িত করেছিল। আঁদ্রে মালরোর বাংলাদেশের পক্ষে লড়বার সংকল্প বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে পল ক্যুয়ে। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটিয়ে বসলেন, প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে এসে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বোয়িংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন পল ক্যুয়ে। তিনি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তার ব্যাগে বোমা আছে। তাঁর ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসা বৈদ্যুতিক তার জানান দিয়েছিল ভেতরে বহন করা বোমার ব্যাপার। এরপর তিনি এক অদ্ভুত দাবী জানিয়ে বসলেন- না, টাকা-পয়সা কিছু না, জাহাজে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়তে থাকা মুক্তিকামী মানুষের জন্য অবিলম্বে ২০ টন মেডিকেল সামগ্রী ও রিলিফ প্লেনটিতে তোলা না হলে এটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। অবশ্য তিনি সফল হতে পারেননি, ক্যুয়ের দাবী অনুযায়ী বিমানে রিলিফ সামগ্রী তোলা হয়। রেডক্রস ও বিমানবন্দর কর্মীদের ছদ্মবেশে পুলিশ অবশেষে তাকে গ্রেফতার করে। ব্যাগ খুলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে কতগুলো বই, এক কপি বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রিক শেভার। শেষ হয় প্রায় পাঁচ ঘন্টার এই ছিনতাই অধ্যায়। ওষুধ এবং রিলিফ সামগ্রী অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স এবং সেটার দায়িত্ব দেওয়া হয় অদ্রে দা মাল্তে নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে।

তার পরপরই উপমহাদেশে শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক যুদ্ধ। সেই ডামাডোলে হারিয়ে যায় পল ক্যুয়ে-র এই লোমহর্ষক ঘটনা। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা চলেছিল বেশ কিছুকাল। আদালতে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আঁদ্রে মালরো স্বয়ং। অবশ্য অভিযোগ থেকে খালাস পেয়ে যায় পল ক্যুয়ে, এবং তারপর আবার বেরিয়ে পড়েছেন অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে।


ডা. জিওফ্রে ডেভিস

devis.jpg

একাত্তরে এদেশের নারীদের উপর যে বিভৎস নির্যাতন চালিয়েছিল পাক বাহিনী তা মানব ইতিহাসে বিরল। এই যুদ্ধে একটি বড় ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল নারী ধর্ষন। যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ধর্ষন ছিল পাক বাহিনীর একটি ‘অস্ত্র’। এটি ছিল পাকিদের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, অত্যন্ত সুকৌশলে এ দেশের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের “উত্তরসূরি” রেখে যাওয়া, যাতে এরা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে। দেশের কোন অঞ্চলই বাদ পড়েনি, তারা সারা দেশে যত্রতত্র এই কার্যক্রম চালায়। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। যাতে পালাতে না পারে তাই বিবস্ত্র করে রাখা হত, মাথায় চুল পেচিয়ে যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে তাই তাদের মাথার চুল কেটে ফেলা হত। ধর্ষন করা হত দিনের পর দিন। এর ফলশ্রুতিতে এই বিশাল সংখ্যক ধর্ষিতা নারীদের একটি বড় অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার পর এইসব নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে তাদের পরিবারগুলি। তাদের স্বাভাবিক জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজব্যবস্থা এবং বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেককেই তাদের এমন কি অনেক মুক্তি-যোদ্ধা স্বামীরাও গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঐ পরিস্থিতিতে অনেককেই বেছে নিতে বাধ্য করে আত্মহত্যার পথ। আবার অনেকে গর্ভপাতের মাধ্যমে মুক্ত হতে চেয়েছে এই আপদ থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের গর্ভপাত ঘটাতে চিকিৎসা সহায়তা দিতে ১৯৭২ সালে এগিয়ে আসেন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস। অস্ট্রেলীয় ইতিহাস গবেষক ড. বিনা ডি কস্তা কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাতকার থেকে উঠে আসে এক বাস্তব চিত্র। সাক্ষাতকারের বিভিন্ন অংশে ডঃ ডেভিস বলেন-
“আমি দেশের অন্য শহরগুলোতেও কাজ করেছি যেখানে হাসপাতালের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি সেখানকার অনেক মানুষকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরপর দেখলাম এর সংখ্যা আরো বেড়েই চলেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হাল ধরলে আমি সে স্থান ছেড়ে অন্য স্থানে ছুটে গেছি।“
“সবচেয়ে সুন্দরী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে বাকিদের সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হতো। এদেরকে খুব কষ্ট দেয়া হতো এবং পর্যাপ্ত খাবারও দেয়া হতো না। অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেয়ার ফলে অনেকেই ক্যাম্পের মধ্যে মারা গেছে।”
“ওই সময় কেবল নারী ধর্ষণের বিষয়টিই মুখ্য ছিল না; যুদ্ধশিশু বিষয়টিও প্রধান হয়ে ওঠে। এসব যুদ্ধশিশুর লালন-পালনের ভার তুলে দেয়া যাচ্ছিল না কারো ওপর। সে সময় কয়েকটি সংগঠন এসব যুদ্ধশিশুদের ইউরোপে পাঠাতে তৎপর হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে তাদের দেখভালের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আর যেসব হোমস ছিল সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসব যুদ্ধশিশু দত্তক নিতো।“

ডা. ডেভিস সাড়া দেশে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং বিভিন্ন জেলায় চালানো নমুনা জরিপের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান তৈরি করেন। তাঁর সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশী। তিনি আরও জানান শুধুমাত্র অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই প্রায় ২ লাখ।


কনসার্ট – গুডবাই সামার

Goodbye summer concert - group.jpg

জর্জ হ্যারিসনের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে একাত্তরের ১লা জানুয়ারী অনুষ্ঠিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কথা সবাই জানে কিন্তু অনেকেই জানে না তার ঠিক দেড় মাস পরই ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী টেস্ট ক্রিকেটের ভেন্যু কেনিংটন ওভালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ রকম আরেকটি কনসার্ট। ‘গুডবাই সামার’ নামের সেই কনসার্টেরও উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশী অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ করা।

এই কনসার্টের প্রমোটার ছিলেন হার্ভে গোল্ডস্মিথ আর মূল উদ্যোগটি নিয়েছিল ‘কস্তুর’ নামের একটি দাতব্য সংগঠন। তারা বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য তুলছিল। বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের শরনার্থীদের কথা উল্লেখ করে কনসার্টের টিকিট মূল্য ধরা হয়েছিল দেড় পাউন্ড। অনুষ্ঠানের আগের রাত পর্যন্ত দশ হাজার টিকিট বিক্রি হলেও অনুষ্ঠানের দিন পাল্টে যায় চিত্র। সেই সময়ের রক এন্ড রোল কাঁপানো দ্য হু’র বিজ্ঞাপনের কারণে কিংবা সব তারকা শিল্পীদের উপস্থিতির কারণেই হোক স্টেডিয়ামের ধারণ ক্ষমতা ত্রিশ হাজার হলেও সেদিন দর্শক হয়েছিল প্রায় চল্লিশ হাজার!

অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশীদের সাহায্যের জন্য সেদিন পেয়েছিল পনেরো হাজার পাউন্ড। সেইসাথে দ্যা ফেস এর ভোকাল রড স্টুয়ার্টের ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা না বললেই নয়! সেদিন তিনি তার গাঁয়ের জ্যাকেটটি নিলামে তোলেন এবং সে বাবদ তহবিলে আরও যোগ হয় পাঁচশ পাউন্ড!


বাল্টিমোর বন্দরের শ্রমিক ও স্থানীয় জনগন

group photo.jpg

আমেরিকার মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের একটি শহর বাল্টিমোর। এখানে একটি সমূদ্রবন্দর রয়েছে যার নাম বাল্টিমোর সমূদ্রবন্দর। এই বন্দরে প্রতিদিন ভিড় করে বিশাল বিশাল সব জাহাজ, যাতে পণ্য উঠা নামায় কাজ করে অনেক শ্রমিক। ১৯৭১ সালের ১৪ই জুলাই এই বন্দরের একদল শ্রমিক ও স্থানীয় কিছু জনগন পশ্চিম পাকিস্তানের ‘পদ্মা’ নামের একটি যুদ্ধ জাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা প্রদান করে। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের কার্গো জাহাজে অস্ত্র বন্ধ করতে কোয়ার্কাস নামের একটি দল কতগুলো ডিঙ্গি নৌকা (কায়াক ও ক্যানু) দিয়ে বাধ তৈরী করে ঐ জাহাজের গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়। সেদিন সেই প্রতিবাদ করতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের দলনেতা চার্লস খান সহ গ্রেপ্তার হয়েছেন ছয়জন ফিলাডেলফিয়ান। সেদিন চার্লস খানের সঙ্গে নেতৃত্বে ছিলেন আরও একজন, তিনি হলেন মি. ডিক টেলর (যার ছবি দেয়া হয়েছে)।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অন্য যারা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন, পাইন স্ট্রিটের স্যালি উইলবি ও স্টেফানি হলিম্যান, উইলোজ এভিনিউর চার্লস গুডউইন এবং মেডিয়ার ওয়েইন লাউসার। এই আন্দোলনের ফলে গ্রেফতারকৃতদের অবশ্য ছেড়ে দেয়া হয় কিন্তু মূল কাজ যেটি হয় তা হল মার্কিন মিডিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে খবরটি। তার পরপরই ঘটে আরেকটি অসাধারণ ঘটনা- পোর্ট শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকে বসে। ‘ক্ষুধার্ত থাকবো তবু রক্তমাখা টাকা নেবনা’ এই শ্লোগান জানিয়ে তারা পাকিস্তানী জাহাজে মালামাল তুলতে অস্বীকৃতি জানায়। সরকারী হস্তক্ষেপে সবকিছু স্বাভাবিক হলেও ততক্ষণে সাধারণ মার্কিনীদের কাছে আসল ঘটনাটি পরিস্কার হয়ে যায়।

বাল্টিমোরের জনগনের সেদিনের সেই প্রতিবাদের ফলে জাহাজটি বন্দর থেকে কোন অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি জাহাজে তুলতে পারেনি। স্থানীয় মানুষদের বাংলাদেশের মানুষের প্রতি এই সহানুভূতির ফলে সেদিন পুরো আমেরিকা এবং বিশ্বের অনেক দেশের জনগণ বাংলাদেশে সংগঠিত পাক বাহিনীর হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারে।

চলবে....

আগের পর্বগুলিঃ

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-২)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৩)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৪)

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 07/07/2013
সর্বমোট 2992 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ