উৎসর্গঃ চুপকথা, শামুক, সাকিয়া রিপা, বিভা, স্বপ্নের কারিগর, নাফিসা
ইসলাম এবং অণু; যাদের লেখায় প্রাণ খুঁজে পাই।
বাংলা ভাষা দুটি ন/ণ আছে যার উচ্চারণ মূলত একই রকম। এর একটিকে বলে দন্ত্য-ন।
এটি উচ্চারণের সময় জিহবার অগ্রভাগ দাঁত বা দন্ত স্পর্শ করে বলে একে দন্ত্য-ন বলে।
আরেকটি উচ্চারণের সময় জিহবার অগ্রভাগ মুখ গহব্বরের ছাঁদ বা তালুর সামনের
দিকে দাঁত বা দন্তমূলের উপরিভাগ যাকে মূর্ধা বলে সেখানে স্পর্শ করে বলে একে মূর্ধন্য-ণ
বলে।
কোন্ শব্দে দন্ত্য-ন বসবে এবং কোথায় মূর্ধন্য-ণ বসবে তা কতগুলো নিয়ম মেনে
চলে। এই নিয়মসমূহকে ণত্ব বিধান বলে।
এই বিধান আলোচনার পূর্বে বাংলাভাষার শব্দের উৎপত্তিটা একটু আলোচনা করা
দরকার। উৎপত্তিগথ দিক দিয়ে বাংলা ভাষাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়।
তৎসম
শব্দ: সংস্কৃত ভাষার যে সব শব্দ প্রাকৃত বা অপভ্রংশের মাধ্যমে পরিবর্তিত
হয়নি, বরং সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সে সব শব্দকেই বলা হয়
তৎসম শব্দ। উদাহরণ- চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য ইত্যাদি।
অনেক তৎসম শব্দেরই
অর্ধ-তৎসম ও তদ্ভব রূপও বাংলায় ব্যবহৃত হয়। যেমন, সূর্য˃ সুরুয, মনুষ্য˃ মানুষ।
অর্ধ-তৎসম শব্দ: যে সব সংস্কৃত শব্দ কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত গৃহীত
হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম। এগুলো সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকেই কিছুটা সহজ
আকারে গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষার মাধ্যমে বাংলায় আসেনি।
যেমন, জ্যোৎস্না˂ জ্যোছনা, শ্রাদ্ধ˂ ছেরাদ্দ, গৃহিণী˂ গিন্নী, বৈষ্ণব˂ বোষ্টম, কুৎসিত˂ কুচ্ছিত।
তদ্ভব শব্দ: বাংলা ভাষা গঠনের সময় প্রাকৃত বা অপভ্রংশ থেকে যে সব শব্দ পরিবর্তিত
হয়ে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছিলো, সেগুলোকেই বলা হয় তদ্ভব শব্দ। অবশ্য, তদ্ভব শব্দের
মূল অবশ্যই সংস্কৃত ভাষায় থাকতে হবে। অর্থাৎ, যে সব শব্দ সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত
হয়ে প্রাকৃত বা অপভ্রংশে ব্যবহৃত হয়েছিলো, পরে আবার প্রাকৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে
বাংলায় গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকেই বলা হয় তদ্ভব শব্দ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস
থেকেই বোঝা যায়, মূলত এই শব্দগুলোই বাংলা ভাষা গঠন করেছে। আর তাই এই শব্দগুলোকে
বলা হয় খাঁটি বাংলা শব্দ। যেমন, সংস্কৃত ‘হস্ত’ শব্দটি প্রাকৃততে ‘হত্থ’ হিসেবে
ব্যবহৃত হতো। আর বাংলায় এসে সেটা আরো সহজ হতে গিয়ে হয়ে গেছে ‘হাত’। তেমনি, চর্মকার˂ চম্মআর˂ চামার।
দেশি শব্দ: বাংলা ভাষাভাষীদের ভূখণ্ডে অনেক আদিকাল থেকে যারা বাস করতো, সেইসব
আদিবাসীদের ভাষার যে সব শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সে সব শব্দকে বলা হয় দেশি
শব্দ। এই আদিবাসীদের মধ্যে আছে- কোল, মুণ্ডা, ভীম, ইত্যাদি। মেমন, কুড়ি (বিশ)- কোলভাষা, পেট (উদর)-
তামিল ভাষা, চুলা (উনুন)- মুণ্ডারী ভাষা।
বিদেশি শব্দ: বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা অন্য ভাষাভাষীর মানুষের
সংস্পর্শে এসে তাদের ভাষা থেকে যে সব শব্দ গ্রহণ করেছে, বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে
অন্য ভাষার শব্দ গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় বিদেশি শব্দ। যে কোনো ভাষার
সমৃদ্ধির জন্য বিদেশি শব্দের আত্মীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এদিক দিয়ে বাংলা ভাষা
বেশ উদারও বটে।
দন্ত-ন ও মূর্ধ-ণ ব্যবহারের প্রধান কয়েকটি ছহি-তরিকাঃ
১. তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে দন্ত্য-ন না বসে মূর্ধন্য-ণ
বসে
২. যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলির (ট ঠ ড ঢ ণ)র পূর্বে মূর্ধন্য-ণ
ণ্ট (ণ+ট) ঘণ্টা,
নিষ্কণ্টক, বণ্টন
ণ্ঠ (ণ+ঠ) অবগুণ্ঠন, উৎকণ্ঠা, লুণ্ঠন
ণ্ড (ণ+ড) কলকুণ্ডলি, ঠাণ্ডা, লণ্ডভণ্ড
ণ্ঢ (ণ+ঢ) ঢুণ্ঢি, ঢেণ্ঢন (তেমন প্রচলিত নয় এই শব্দগুলি)
ণ্ন (ণ+ন) অক্ষুণ্ন, ক্ষুণ্ন, বিষণ্ন
ব্যতিক্রম:
* ক্ষুন্নিবৃত্তি
(ক্ষুৎ+নিবৃত্তি) এবং ক্ষুণ্নি শব্দের উৎস এক নয়। প্রথমটি সাধিত (সন্ধিজাত) শব্দ,
যেখানে ৎ+ন=ন্ন (ন এর দ্বিত্ব) হয়েছে।
* বিদেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমনঃ ওয়ারেন্ট, কমান্ডার, পান্ডা।
৩. ঋ, র, ষ, ক্ষ এর পর দন্ত্য-ন না বসে মূর্ধন্য-ণ
বসে
৩.১. ঋ বা ঋ-কারের পর - ঋণ,
ঘৃণা, মৃণাল
৩.২. র, র-ফলা, রেফ এর পর
- অরণ্য, আহরণ, উদাহরণ,
ভ্রূণ, মিশ্রণ, স্ত্রৈণ, অর্ণব, পূর্ণিমা, বিশীর্ণ।
ব্যতিক্রম: এই নিয়মানুসারে রেফ এর পর মূর্ধন্য-ণ হয় বলে তৎসম শব্দে "রেফ-যুক্ত
দন্ত-ন" সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু সাধিত শব্দে (উপসর্গ, সন্ধি বা সমাসযোগে
গঠিত শব্দ) এর ব্যতিক্রম দেখা যায়: অহর্নিশ (অহ+নিশ), দুর্নীতি (দুর্+নীতি,
দুর্নাম (দুর্+নাম)।
৩.৩. ষ এর পর - অন্বেষণ, নিষ্পেষণ,
ভাষণ
জ্ঞাতব্য:
"ষ এর সাথে ণ যুক্ত" হলে, যুক্তবর্ণের চেহারা হবে ষ্ণ: যেমন, কবোষ্ণ,
বৈষ্ণব, উষ্ণীষ, কৃষ্ণ।
৩.৪. ক্ষ এর পর ‘ণ’ বসে - ক্ষ=ক+ষ, সুতরাং ক্ষ এবং
ষ এর নিয়ম একই। যেমন: ঈক্ষণ, তীক্ষ্ণ, সমীক্ষণ।
৪. একই শব্দে ঋ/র, র-ফলা, রেফ/ষ, ক্ষ এদের যেকোনটির পরে যদি স্বরবর্ণ,
ক-বর্গের বর্ণ (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের বর্ণ (প ফ ব ভ ম), য য় হ ং এই সব বর্ণের এক
বা একাধিক থাকে, তবে তার পরে মূর্ধন্য-ণ হবে। যেমনঃ রোপণ (র+ও+প+ন্), শ্রাবণ
(শ+র+আ+ব+ন্)
ব্যতিক্রম: ঋ/র, র-ফলা, রেফ/ষ, ক্ষ/ এর পরে অন্য বর্গের বর্ণ থাকলে মূর্ধন্য-ণ হবে না: দর্শন,
প্রার্থন.
সন্ধিজাত বা সাধিত শব্দের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য নয়: যেমন - নিষ্পন্ন (নি:+পন্ন)।
শব্দের শেষ বর্ণটিতে হসন্ত-উচ্চারণ থাকলেও এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়: শ্রীমান্।
৫. সাধিত শব্দে মূর্ধন্য-ণ
সাধিত শব্দে ঋ, র ষ ক্ষ
এর পর সাধারণত মূর্ধন্য-ণ হয় না। তবে বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ণ হতে পারে। যেমন -
৫.১. পরি-, প্র-, নির-
এই ৩টি উপসর্গের পর ণ হয়: পরিণয়, প্রণাম, নির্ণয়।
ব্যতিক্রম: পরিনির্বাণ,
নির্নিমেষ।
৫.২. র বা র-ফলা'র পরপদে -অয়ন থাকলে এর ন মূর্ধন্য-ণ
হবে: উত্তরায়ণ, চান্দ্রায়ণ, রবীন্দ্রায়ণ।
৫.৩. সাধিত কিছু শব্দে
"র" এর প্রভাবে ন মূর্ধন্য-ণ'তে পরিণত হয়: অগ্রণী, গ্রামীণ। ব্যতিক্রম:
অগ্রনেতা।
৫.৪. সাধিত শব্দ কোন কিছুর নাম বুঝাতে এক শব্দ
বিবেচিত হলে ণ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য: শূর্পণখা (শূর্প+নখা), অগ্রহায়ণ।
৫.৫. গণ ধাতু সহযোগে গঠিত শব্দ সমূহে ণ হবে: গণিত,
গণনা, গণ্য; গণৎকার; গণশক্তি, জনগণ, গণসংগীত।
৬. নিত্য মূর্ধণ্য-ণ
অণু, কণা, কোণ,ফণা,
বেণী, শাণ, কঙ্কণ, বাণ, ভণিতা, শোণিত, ঘুণ, বীণাপাণি, লাবণ্য, বিপণি, মাণিক্য,
চাণক্য, গণেশ প্রভৃতি।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ লেখা যে কি কষ্ট!!! কতো যে পড়তে হয়! পাঠক-ব্লগারদের বলি, বিধান-ফিধান বা ছহি তরিকা মনে না থাকুক, যে কয়টি বানান এখানে দেওয়া হয়েছে সে কটি
সংগ্রহে রাখলেও লেখার সময়ে কনফিউশন হলে অনেক মুশকিল আসান হয়ে যাবে। (পাঠক চাইলে
চলবে, না চাইলে থামবে)