উৎসর্গঃ ব্লগার
আমি বাঙ্গাল, লজিক্যাল বাঙ্গালী এবং বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলসহ তার আশপাশের অঞ্চলসমুহের
মানুষ-জন।
‘রত্ব ও ড়ত্ব বিধান’ বলে কোন
বৈধ বাংলা শব্দ কশ্চিন কালেও কেউ শোনে নাই। এটি কোন প্রচলিত বিধান নয়, এমনকি অপ্রচলিত
বিধানও নয়। এটা স্বীকৃত বিধানও নয়, অস্বীকৃত বিধানও নয়। বাংলা ভাষায় এমন বিধান বলে
কিছু নেই। ভবিষ্যতে হবে কিনা তাও জানিনা। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলসহ তার আশপাশের অঞ্চলসমুহ
যেমন ফরিদপুর ও মাদারীপুরের বরিশাল-সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের উচ্চারণ দুষ্টতাকে
যদি কখনও আমলে নেওয়া হয় তাহলে এই অদ্ভুত বিধান চালু হতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা নেই।
কারণ, এই বর্ণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বর্ণ যার
উচ্চারণও একেবারেই আলাদা। স্থানীয় মানুষের উচ্চারণের দুষ্টতার কারণে বর্ণ দুটিকে
কাছাকাছি মনে হলেও আসলে মোটেও তা নয়। সুতরাং ‘রত্ব ও ড়ত্ব বিধান’কে বলা যেতে পারে একটা
‘স্বেচ্ছা বিধান’।
বরিশালের স্থানীয় আমার এক বন্ধুর
ছোটভাই বরিশালের জেলা আদালতের উকিল। সে একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল-
- বাইয়া, এইয়া এরমের ক্যান কন
দেহি? দুইডা ‘র’ থাহার কোন মানে অয়?
- কোথায় দুইটা ‘র’, ‘র’ তো একটাই।
- আমার কথায় হাসতে হাসতে তার
প্রাণ যাবার যোগাড়। শেষে বলল, বাইয়া কি কয়!
আমনে মেডিকেলে ফড়েন আর দুইডা ‘র’ এইয়া জানেন না, আমাগো লগে মসকরা হরেণ বাইয়া।
- না না দুষ্টামিনা, আমিতো সত্যি
সত্যিই জানি ‘র’ একটাই।
- শোনেন বাইয়া, এট্টা অলো গিয়া
‘বয় শূণ্য র’, আরেট্টা অইল গিয়া ‘ডয় শূণ্য র’।
- ও আচ্ছা, এর একটা হলো ‘র’ আরেকটা
হলো ‘ড়’। ‘বয় শূণ্য দিয়ে যেটা, সেটা হলো র’,
আর ‘ডয় শূণ্য দিয়ে যেটা, সেটা হলো ড়’।
এরপরে অনেক্ষণ উচ্চারণ চর্চা
করিয়েও কোন লাভ হলোনা। ‘গুড়’ বলতে বললে বলে ‘গুর’। ‘খাঁড়া’ বলতে বললে বলে ‘খারা’।
‘দাড়া’ বলতে বললে বলে ‘দারা’। ‘ন্যাড়া’ বলতে বললে বলে ‘ন্যারা’। ভাগ্যিস ‘বাড়া’ বলতে
বলি নাই, বললে কি বলতো কে জানে!
যে ধ্বনি ঠিকমতো উচ্চারণ করা যায়না, অন্য কেউ সে ধ্বনি ঠিকমতো উচ্চারণ
করলে তা ঠিকমতো শোনাও য়ায়না।
উচ্চারণের বিষয়টি চর্চার। আমার দুই বাচ্চার নামেই ‘ত’ আছে।
অষ্ট্রেলিয়াতে থাকা অবস্থায় কোন অষ্ট্রেলিয়ানকেই আমি তাদের নামের ‘ত’ উচ্চারণ
করাতে পারিনি। তারা বলতো ‘ট’, যেহেতু তাদের ভাষায় বাংলা ‘ত’ এর কোন প্রতিবর্ণ নেই।
এই উচ্চরণের চর্চাটা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে একটু আলোচনা করা
যেতে পারে। তার আগে ‘ড়’ ও ‘র’ এর সাথে আরেকবার একটু গভীরভাবে পরিচিত হতে হবে।
‘ড়’ সম্পর্কে আলোচনাঃ
বাংলা বর্ণমালার ‘ড়্’ একটি মূর্ধন্য
তাড়নজাত ব্যঞ্জনধ্বনি। এই ধ্বনিটি বিশ্বের অনেকগুলো কথ্য ভাষায় ধ্বনিমূলক
হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাংলায় এ ধ্বনিটি কখনোই শব্দের আদিতে বসে না। যেমনঃ কড়া,
বড়া, গাড়ি, ঘাড়, চড়া ইত্যাদি। তবে বিশ্বের অনেক ভাষায় এই ধ্বনিটি শব্দের যেকোনো
স্থানে বসতে পারে।
মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে?
যেসব ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণকালে জিহ্বার ডগা সামান্য উল্টে
গিয়ে মূর্ধা স্পর্শ করে বা তার কাছে নিকটবর্তী হয় সেগুলোকে মূর্ধন্য
ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। একে প্রতিবেষ্টিত ব্যঞ্জনধ্বনিও বলা হয়ে থাকে।
মূর্ধা কী?
মূর্ধা চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে 'ট'-বর্গীয় কোনো একটি
ধ্বনি (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ) উচ্চারণ করা। এই ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় জিহ্বার অগ্রভাগ
মুখমণ্ডলের ভেতরে ওপরের চোয়ালের যে জায়গা স্পর্শ করে সেটাই মূর্ধা। যে সকল বর্ণ
উচ্চারণে মূর্ধা ব্যবহৃত হয় সেগুলিকে মূর্ধন্য ধ্বনি বলে।
বর্তমান বাংলা ভাষায় বিশুদ্ধ মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনিকে দন্তমূলীয়
বা পশ্চাদ্দন্তমূলীয় ধ্বনি হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
মূর্ধন্য তাড়নজাত ব্যঞ্জনধ্বনি কী?
যেসব ধ্বনির উচ্চারণকালে উচ্চারক অঙ্গ বা জিহবার অগ্রভাগ মূর্ধার
উচ্চারণস্থানে দ্রুত সংকুচিত হযয়ে বর্ণগুলি উচ্চারিত হয় সেগুলোকে তাড়িত বা তাড়নজাত মূর্ধণ্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়।
‘র’ সম্পর্কে আলোচনাঃ
একসময় র হরফটিকে পেটকাটা ‘ব’ দিয়ে লেখা হতো। যা এখনও অসমীয়া
লিপিতে প্রচলিত আছে। বাংলায় আর এর প্রচলন নেই। ১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল ব্রাসি
হালেদের লেখা A Grammar of the Bengal Language প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা
মুদ্রণশিল্পের জন্ম হয়। জানা যায়, ওই সময় ‘র’ হরফটি পেট কাটা ‘ব’ এবং ব-য়ের নিচে
ফুটকি উভয় রূপেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে এসে বর্তমান
ফুটকিযুক্ত রূপটিই সর্বত্র চালু হয়ে যায়।
‘র’ দন্তমূলীয় বর্ণ। বর্ণটি উচ্চারণের সময়ে জিহবার অগ্রভাগ
দন্তের মূল স্পর্শ করে বলে এর এমন নামকরণ হয়েছে।
‘ড়’ ও ‘ঢ়’ সম্পর্কে আলোচনাঃ
প্রথমদিকে বাংলা ভাষায় ‘ড়’ এবং ‘ঢ়’ বর্ণ দুটি ছিল না। সে
সময়ে ‘ড’ এবং ‘ঢ’ বর্ণদুটি শব্দের মাঝে বসলে ড় এবং ঢ়-য়ের মতো উচ্চারিত হতো। ‘ড’
ও ‘ঢ’-য়ের নিচে ফুটকি দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম ‘ড়’ ও ‘ঢ়’ হরফ
দুটির প্রচলন করেন। উল্লেখ্য, সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত হরফ সরাসরি নকল না করে বাংলা
ভাষার উচ্চারণ অনুযায়ী বাংলা হরফ নেবার বৈপ্লবিক উদ্যোগ বিদ্যাসাগরই প্রথম
নিয়েছিলেন।
‘ড়’-য়ের শুদ্ধ উচ্চারণ কৌশলঃ
‘ড়’ বর্ণের উচ্চারণের সময়ে জিহ্বার ডগাটি উল্টিয়ে অর্থাৎ
জিহ্বার ডগার পিছন দিকটি খুব দ্রুত মূর্ধা স্পর্শ করেই নীচ দন্তমূল স্পর্শ করাতে
হবে।
‘র’-য়ের শুদ্ধ উচ্চারণ কৌশলঃ
‘র’ উচ্চারণের সময়ে জিহবার অগ্রভাগ স্বাভাবিক রেখে অর্থাৎ ‘ড়’
বর্ণের উচ্চারণের সময়ে যেভাবে জিহ্বার ডগাটি উল্টনো হয় সেভাবে না উল্টিয়ে উপরের
দন্তমূল স্পর্শ করতে হয়।
‘ঢ়’-য়ের শুদ্ধ উচ্চারণ কৌশলঃ
‘ড়’ উচ্চারণের পরে অর্থাৎ জিহবা নীচ দন্তমূল স্পর্শ করার পরেই
খুবই দ্রুতই তা আবার ‘ড়’ উচ্চারণের শুরুতে যেমন উল্টে গিয়ে মূর্ধা স্পর্শ করেছিল
সেভাবে মূর্ধায় গিয়ে বায়ু চেপে ধরে ছেড়ে দিতে হয়।
যেখানে যেখানে উচ্চারণে সমস্যা হয়ঃ
মূর্ধাকে খুব দ্রুত বেগে স্পর্শ করে উচ্চারণ করলে তা সঠিক
মূর্ধন্যধ্বনি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ‘ড়’ ও ‘ঢ়’ অক্ষরগুলো মূর্ধন্য তাড়নজাতধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয় না বরং মূর্ধন্য অথবা দন্তমূলীয় অন্তঃস্থধ্বনি রূপে
উচ্চারিত হয়। যে কারণে এইসব অঞ্চলে ড়, ঢ়, আর র-য়ের উচ্চারণে তেমন কোনো পার্থক্য
নেই।
‘ড়’ ও ‘র’ সম্পর্কীয় কিছু প্রচলিত বানান-বিভ্রাটঃ
এখানে
গরু চড়ানো নিষেধ > এখানে গরু চরানো নিষেধ
‘চড়ে’
শব্দের অর্থ ‘আরোহণ করে’। যেমন, দোলায় চড়ে, গাছে চড়ে। ‘চরে’ শব্দের অর্থ ‘বিচরণ করে’।
আমি
হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম > আমি হাঁটতে বেরিয়েছিলাম (বের হয়েছিলাম)
পড়নে ঢাকাই শাড়ি >পরনে ঢাকাই শাড়ি (পরিধানে)
মুখটি বেজাড় কেন?> মুখটি বেজার কেন? (মলিন)
আজ কী শাড়ি পড়েছ?> আজ কী শাড়ি পরেছ? (পরিধান
করেছ)
আজ
কী বই পরেছ?> আজ কী বই পড়েছ? (পাঠ)
কখনোই দরকার পরবে না > কখনোই দরকার পড়বে না (প্রয়োজন)
ধরে পানি পেলাম > ধড়ে পানি পেলাম (দেহ)
ঘুরে বেরানো আমার হবি > ঘুরে বেড়ানো আমার হবি (ভ্রমন)
আজকাল সবকিছুর দামই চরা > আজকাল সবকিছুর দামই চড়া (বেশী)
পরামর্শঃ ‘র’, ‘ড়’ বা ‘ঢ়’ এর সঠিক উচ্চারণ কৌশলটি চর্চার বিষয়।
নিজে নিজে বা কারো সহায্য নিয়ে চর্চা করাই উত্তম।