ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৮)

উৎসর্গঃ শামুক

আর্চার কেন্ট ব্লাড, যুক্তরাষ্ট্র

Archer Blood.jpg

একাত্তরে আর্চার কেন্ট ব্লাড তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কুটনীতিক হিসেবে কাজ করতেন। সেই সময়ে তিনি ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের শেষ ‘কনসোল জেনারেল’। একাত্তরে যে ক’জন বিদেশি আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আর্চার কে ব্লাড, যাকে বাংলাদেশের যুদ্ধবিবেকও বলা হয়ে থাকে। ‘সৃজনশীল ভিন্নমতাবলম্বী’ হিসেবে পুরস্কৃত আর্চার ব্লাড নামটি মার্কিন কূটনৈতিক মহলে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটা আড়ালেই রয়ে গেছেন আর্চার কে ব্লাড। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সকল বিদেশী বন্ধুদের অবদান নিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কম বেশী আলোচনা হয়, তাঁর অবদানের কথা তেমনভাবে প্রচারিত হয়না, তাই এখন পর্যন্ত অনেকটা অনুল্লেখযোগ্য রয়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের একজন অন্যতম সুহৃদ আর্চার কে ব্লাডের নাম। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে তিনি তৎকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কুটনীতিক হিসেবে কাজ করতেন, আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। কিন্ত এটা ভুলে গেলে হবে না যে তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান এবং উদ্যোগ ছিল স্পষ্টতই আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে। একটি পরাশক্তির কুটনৈতিক হওয়া সত্বেও নিজের সুবিধা-অসুবিধার তোয়াক্কা না করে, নিজ দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁর সরকারকে কঠোর ভাষায় সমালোচনার ভূমিকায় ছিলেন এই কুটনীতিক।
৬ এপ্রিল ১৯৭১, ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’। মার্কিন কর্মকর্তারা পঁচিশে মার্চের সেই ‘কালো রাতের’ ঢাকায় চালানো গণহত্যা এবং এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের পশ্চিম পাকিস্তান ঘেঁষা নীতির প্রতিবাদ জানাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা খুব ভেবেচিন্তে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন, যা মূলত Blood Telegram নামে আজও আমাদের মহান স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলীল হিসাবে স্বীকৃত। ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ এর অর্থ ছিল অনেকটা এ রকম-

“আমাদের সরকার গণতন্ত্রের দমনে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে তে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার ব্যর্থ হয়েছে কোন শক্তিশালী ব্যাবস্থা গ্রহন করতে এ দেশের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য ,যখন একই সময়ে, পশ্চিম পাকিস্তানী নিয়ন্ত্রিত সরকারের পিঠ চুলকাতে ব্যস্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে নেয়া কোন প্রাপ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত কঠিন কুটনৈতিক ব্যাবস্থা শিথিল করনে। আমাদের সরকার প্রমান করেছে, যা অনেকের বিবেচনয়, আমাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে, (...) অথচ আমরা নিরপেক্ষতা বেছে নিয়েছি, এমনকি মানবিক কারনেও, যে এটা মাঠে জনগনের সংঘাত, শুদ্ধভাবে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যপার, যা দুর্ভাগ্যবশত গণহত্যা হিসাবে প্রযোজ্য। সাধারন আমেরিকান এর প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। আমরা, পেশাদার আমেরিকান কর্মচারী হিসেবে বর্তমান নীতির সাথে আমাদের মত পার্থক্য ব্যক্ত করি এবং নিশ্চিত ভাবে আশা করি যে এখানে আমাদের সত্যি এবং স্থায়ী স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করা যায় আমাদের নীতিমালা পরিবর্তিত করে।“


ব্লাড টেলিগ্রামের স্ক্যান প্রিন্ট

এতে স্বাক্ষর করেছিলেন ব্লাড এবং তাঁর ২০ জন সহকর্মী। তারা তাতে ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক চালানো গণহত্যার প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত নীরবতার নিন্দা জানিয়েছিলেন। ব্লাড তাতে শুধুই স্বাক্ষর দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেইসাথে একটি ব্যক্তিগত নোটও লিখেছিলেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- ‘আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।’ এই ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ ছিল বস্তুত নিক্সন-কিসিঞ্জারের জন্য একটি আঘাতস্বরূপ। ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ এর লেখক ক্রিস্টোফার হিচিনসের ভাষায়, ‘মার্কিন ইতিহাসে ব্লাড টেলিগ্রামের কোনো তুলনা নেই।’ কিসিঞ্জার এ জন্য ব্লাডকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন। তারও আগে, ২৭শে মার্চ ১৯৭১ এ আমেরিকা দৃষ্টিকোন থেকে ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে ব্লাড লিখেছিলেন, যার Heading ছিল ‘Selective Genocide’

Here in Decca we are mute and horrified witnesses to a reign of terror by the Pakistani Military. Evidence continues to mount that the MLA authorities have list of AWAMI League supporters whom they are systematically eliminating by seeking them out in their homes and shooting them down
2. Among those marked for extinction in addition to the A.L. hierarchy are student leaders and university faculty. In this second category we have reports that Fazlur Rahman head of the philosophy department and a Hindu, M. Abedin, head of the department of history, have been killed. Razzak of the political science department is rumored dead. Also on the list are the bulk of MNA's elect and number of MPA's.
3. Moreover, with the support of the Pak[istani] Military. non-Bengali Muslims are systematically attacking poor people's quarters and murdering Bengalis and Hindus.
(U.S. Consulate (Dacca) Cable, Selective genocide, March 27, 1971[6])

বাংলাদেশে অবস্থানকালে রূপসী বাংলার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন আর্চার কে ব্লাড। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি জসীমউদ্দীন ছিলেন ব্লাড পরিবারের অনেক প্রিয়। রূপসী বাংলার রুপ বর্ননায় আর্চার ব্লাড- ‘যত দূর চোখ যায় পানি আর পানি, আদিগন্ত সবুজ ধানক্ষেত, কচুরিপানার বেগুনি রং আর তাতে ঠিকরে পড়া সোনালি সূর্যের ঝিকিমিকি-এই হলো বাংলার যাদু।’

আর্চার কে ব্লাড শুধু একজন বিদেশী সহযোদ্ধাই নয়, তাঁকে বাংলাদেশের একমাত্র আমেরিকান সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাও বলা যায়। কারণ, মার্কিন কূটনীতিক হয়েও একদল বাঙালি পুলিশের অস্ত্র তিনি তার ধানমন্ডির বাসার বাগানে মাটি খুঁড়ে কয়েক দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন।

২০০৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের এই অকৃতিম বন্ধু। তাঁর মৃত্যুতে শোকাভূত হেয়েছিল সারা বাংলাদেশ, কেঁদেছিল বাংলাদশের প্রগতিশীল চেতনার মানুষ। সেদিন বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ খবরের শীরনাম হয়েছিল অথচ নিজ দেশের পত্রিকায় শেষের পৃষ্ঠায় দায়সায়রাভাবে একটা খবর ছাপা হয়েছিল মাত্র ।

আর্চার ব্লাড আজ পৃথিবীতে নেই কিন্তু চিরদিন তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে, অন্যসব বিদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাঁর নামটিও উচ্চারিত হবে, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ‘ব্লাড-টেলিগ্রাম’ বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনন্য সাধারণ এক দলিল হিসাবে।

লিওনেদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন

Brezhnev.jpg

লিওনেদ ইলিচ ব্রেজনেভ ১৯শে ডিসেম্বর ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন। একাত্তরের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের খরব জানতে চেয়ে চিঠি পাঠান। সেই সময়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে কাজ করেন, এর অংশ হিসেবে একাত্তরের জুন মাসে তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড এবং পূর্ব জার্মানী সফর করেন। এই সফরের পর জুলাই মাস থেকেই পূর্ব ইউরোপে কুটনৈতিক সমর্থন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্বের সকল দেশসমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল-চীন। রাশিয়ায় অবস্থানরত পারমানবিক মিসাইলবাহী সোভিয়েত নৌবহর প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে অতি দ্রুত বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থান গ্রহন এবং সপ্তম নৌবহর শক্তি প্রোয়োগের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দেন সোভিয়েত এই কমিউনিস্ট নেতা ব্রেজনেভ।

টাইমস সম্পাদককে জন স্টোনহাউস, বৃটেন

john-stonehouse.jpg

ব্রিটেনের হাউস অফ কমন্স এ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে একটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখেন এমপি জন স্টোনহাউস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশ্ব জনমত গঠনে অনেক সহয়তা করেন এই ব্রিটিশ এমপি। দ্য লন্ডন টাইমসের সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে লেখা তার চিঠিটি প্রকাশিত হয় ৮ জুন ১৯৭১।

পূর্ব পাকিস্তানে মানবতার বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ অপরাধ করে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, তার চিত্র মুছে ফেলা অসম্ভব। সত্যিকার অর্থেই দেশ ছেড়ে পালানো শরনার্থীদের দীর্ঘ সারিই প্রমাণ করে তাদের বিরুদ্ধে নির্মমতা চালানো হচ্ছে এখনও। এই লম্বা জনতার লাইন সামাল দেওয়ার জন্য বিশাল সমস্যা দূর করতে ভারত সরকারকে সাহায্য করা এখন অতিজরুরী। এটা সত্যি, চল্লিশ লাখ শরণার্থী একটি র্যোগের ইঙ্গিত, কিন্তু দুর্যোগের কারণ নয়। শক্তহাতে এই গণহত্যা বন্ধ করার ব্যবস্থা না নিয়ে শুধুমাত্র আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ঔষধ লাগিয়ে বিশ্ববিবেককে আর কত সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে? পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধকৃত সাহায্য কর্তন করে শরণার্থীদের জন্য দিয়ে দেওয়াটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়।

-জন স্টোনহাউস

যদিও স্টোনহাউসের ব্যাপারে বিতর্ক আছে, তবুও শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করতেই তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করলাম। । পরবর্তীতে জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশনার মধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিস্তারিত জানতে চাইলে এই পোষ্টটি দেখতে পারেন।

চলবে......

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-২)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৩)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৪)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৫)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৬)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৭)

ছবি
সেকশনঃ মুক্তিযুদ্ধ
লিখেছেনঃ নিভৃত স্বপ্নচারী তারিখঃ 20/07/2013
সর্বমোট 3582 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ