ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

সমকামিতা (পর্ব-দুই): বৃহন্নলা (উপপর্ব- এক)

সমকামিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর চর্চার সাথে যারা সবচেয়ে বেশি জড়িত তাদের সম্পর্কে সম্পূরক ধারণা থাকা খুবই প্রয়োজন। এমন একটি গোষ্ঠী হচ্ছে হিজড়া বা বৃহন্নলা। 
 
হিজড়া শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। কারও কারও মতে হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবি হিজরত বা হিজরি শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন বা মাইগ্রেট  বা ট্রান্সফার। অন্যদিকে বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে হিজড়া শব্দটির আগমন হয়েছে হিন্দি থেকে। এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় নপুংসক শব্দটি পাওয়া যায়। সাধারণ অর্থে হিজড়ার অভিধানিক অর্থ বলতে আমরা বুঝি একই দেহে নারী ও পুরুষের চিহ্নযুক্ত মানুষ, যারা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম।
 
হিজড়া শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Hermaphrodite. যার আভিধানিক অর্থ উভয়লিঙ্গ। Hermaphrodite শব্দটি এসেছে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী থেকে। উৎপত্তিগতভাবেই শব্দটির মধ্যে এর অর্থ নিহিত আছে। হেলেনিষ্টিক যুগের গ্রিক পুরাণের দুটি চরিত্র হার্মেস এবং আফ্রোদিতি থেকে এসেছে হার্মাফ্রোডাইট শব্দটি। পুরাণ অনুযায়ী হার্মেস ও আফ্রোদিতি দম্পতির সুদর্শন পুত্রের নাম  হার্মাফ্রোদিতাস। হার্মাফ্রোদিতাসের প্রেমে পড়েন ঝর্ণার উপদেবী থেটিস। উপদেবী দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন, সে যেন চিরতরে হার্মাফ্রোদিতাসের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। দেবতারা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এর ফলে দুজনের সংমিশ্রণে তৈরি হয় একজন মানুষ যার বৈশিষ্ট্য ছিল অর্ধপুরুষ ও অর্ধনারী। ইংরেজিতে হিজড়ার প্রতিশব্দ হিসেবে ইউনাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ নপুংসক বা খোজা।
 
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তারাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের অপর অর্থ হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’, ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বুঝায় যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোন শ্রেণিতে পড়ে না।
 
অনেকে মনে করেন হিজড়া শব্দটি মূলত পুরুষবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও এর কোন স্ত্রীবাচক শব্দ নেই। সেই অর্থে শব্দটির পুরুষ বা স্ত্রী-বাচকতার প্রশ্নটি কতোটা যৌক্তিক সেটিও বিবেচ্য।
 
হিজড়া শব্দটির সমার্থক শব্দ হিসেবে বাংলা ভাষায় যে শব্দগুলি ব্যবহৃত হয় তারমধ্যে শিখণ্ডী, বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ, উভলিঙ্গ ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়াও পারিভাষিক শব্দ হিসেবে ইংরেজিতে ট্রান্সজেন্ডার, হিব্রুতে ইনুখ এবং আরবিতে মুখান্নাতুন ব্যবহৃত হয়।

বৃহন্নলাগণ বিশেষ ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধী যা মূলত শারীরিক লিঙ্গের ত্রুটির কারণে সৃষ্ট। এদের লিঙ্গে নারী বা পুরুষের সুনির্দিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্য থাকে না। কারও কারও ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে লিঙ্গ নির্ধারক অঙ্গও সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান থাকে না।

লিঙ্গের প্রকটতা এবং শারীরিক ও মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে এদেরকে  কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়; যেমন- শারীরিকভাবে পুরুষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কিন্তু মানসিকভাবে নারী বৈশিষ্ট্যের প্রকটতা যাদের আছে তাদেরকে বলা হয়, অকুয়া। শারীরিকভাবে নারী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং মানসিকভাবেও নারী বৈশিষ্ট্যের প্রকটতা যাদের আছে তাদেরকে বলা হয়, জেনানা। জন্মগতভাবে পুরুষ কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে লিঙ্গচ্ছেদ বা ক্যাসট্রেটেড করে যারা হিজড়া হয় তাদেরকে বলা হয়, চিন্নি।
 
জন্মগতভাবে হিজড়া হবার মূল কারণ জেনেটিক প্যাটার্নের অসম বিন্যাস। আমরা জানি যে, মানুষের জেনেটিক প্যাটার্নের জন্য দুটি ক্রোমোজোম দায়ী; এদের একটি এক্স এবং অন্যটি ওয়াই। এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বাণুর সমন্বয়ে মেয়ে শিশু আর এক্স ওয়াই প্যাটার্ন থেকে হয় ছেলে শিশু। ভ্রূণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটার্ন বিন্যাসের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ আর মেয়ে শিশুর মধ্য ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন, এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় স্ত্রী হরমোন, ইস্ট্রোজেন। ভ্রূণের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন এক্স এক্স ওয়াই অথবা এক্স ওয়াই ওয়াই বা অন্য কোন প্যাটার্ন এবং এর ফলে জন্ম হয় হিজড়া শিশু। ক্রোমোজোমের বিভিন্ন প্রকার অসম বিন্যাস ও গঠনের কারণে হিজড়াদের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
 
ক্রোমোজোমের প্রভাবে হিজড়াদের যে শারীরিক গঠন হয়, সেখানে মূলত তিন ধরণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যেমন- সকল নারী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলেও নারী জননাঙ্গের অনুপস্থিতি, পুরুষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলেও পুরুষ জননাঙ্গের অনুপস্থিতি এবং নারী ও পুরুষের উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। (ক্রমশ..) 
 

এই সিরিজ এর সব লেখা
ছবি
সেকশনঃ অন্যান্য
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 07/05/2015
সর্বমোট 24388 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ