ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

সমকামিতা (পর্ব-আট): সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন ও প্রিফারেন্স

‘সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স’ এর বাংলা প্রতিশব্দ হয়ত কোথাও না কোথাও আছে কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত সেটি পাইনি, ফলে আমি নিজেই এটিকে ‘যৌন পছন্দ’ বলে অভিহিত করছি। ‘সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন’ এর ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। এমন কোন যুতসই প্রতিশব্দ এখানেও পাচ্ছি না ফলে এটিকেও আমি ‘যৌনাকর্ষণ অনুভূতি’ বলে প্রকাশ করছি। আলোচনার সময়ে দুটি বিষয়কে অনেক সময়ে এক রকম মনে হলেও আসলে বিষয় দুটি ভিন্ন। যদিও কখনও কখনও একটি অপরটির সম্পুরক, তারপরেও বিষয় দুটি আলাদা।
 
মানুষের যৌন রোমান্টিকতা ও যৌন আকর্ষণের বিষয়টিকে যৌনস্বাস্থের ভাষায় বলা হয়, ‘সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন’। সাধারণত নারী ও পুরুষের মধ্যে অর্থাৎ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে যৌন আকর্ষণ অনুভূত হয় সেটিকে বোঝাতে সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণ বা অরিয়েন্টেশন বলতে পুরুষের আকর্ষণ নারীর প্রতি আর নারীর আকর্ষণ পুরুষের প্রতি বোঝান হয়। এটির আরেক নাম হেটারোসেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন। কোন কোন সজ্ঞায় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি, তবে আলোচনায় গিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  
 
‘সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স’ বা ‘যৌন পছন্দ’ বিষয়টি হল চয়েচ বা পছন্দ সংক্রান্ত। এটি ‘সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন’ থেকে আলাদা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- একজন ব্যক্তি হেটারোসেক্সুয়াল এটি তার ‘অরিয়েন্টেশন’ কিন্তু একাধিক বিপরীত লিঙ্গের যৌন সাথীর মধ্যে কাকে সে পছন্দ করে নেবে সেটি তার ‘প্রিফারেন্স’। অন্যদিকে একই ব্যক্তি যদি একাধিক ‘অরিয়েন্টেশন’ এ অভ্যস্ত হয় যেমন একই সাথে হেটারোসেক্সুয়াল ও বাই-সেক্সুয়াল তাহলে সে কখন কোনটিকে বেঁছে নেবে সেটি হল ‘প্রিফারেন্স’।
 
সমগোত্রের প্রতি যৌন আকর্ষণকে বলে হোমোসেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন। যেমন, পুরুষের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ বা নারীর প্রতি নারীর আকর্ষণ। ক্ষেত্র বিশেষে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিটি অরিয়েন্টেশনেরই ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। যেমন- নারীর প্রতি নারীর আকর্ষণের নাম লেসবিয়ানিজম। নারী পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ না হয়ে অন্য কোথাও হলে তাকে বলে ‘প্যারাফিলিয়া’। বর্তমানে হোমোসেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনকে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বলে দাবী করা হচ্ছে যদিও এ নিয়ে শক্তিশালী মতবিরোধ আছে। যৌন আকর্ষণ শুধু এই হেটারোসেক্সুয়াল এবং হোমোসেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও নানা ধরনের যৌন আকর্ষণ বা অরিয়েন্টেশন আছে। সেগুলিকে সেক্সুয়াল পারভারশান বলা হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে মতামত প্রকাশকারীদের মধ্যে কোন দ্বিমত নাই অর্থাৎ এগুলিকে কেউই স্বাভাবিক যৌন আচরণ বা অরিয়েন্টেশন বলে দাবী করছে না।
 
‘প্যারাফিলিয়া’ এমন একটি বিষয় যেখানে মানুষের যৌন আকর্ষণ নারী বা পুরুষের প্রতি না হয়ে কোন বস্তু, কাজ, চিন্তা, এমনকি অনুভুতির উপরও হতে পারে। নারী পুরুষ ব্যাতীত সেই বস্তু বা কাজের কথা চিন্তা করে ব্যক্তিটি যৌন অনুভুতি পেয়ে থাকে। এ জন্যে ব্যক্তিটি সেই বিশেষ বস্তু বা চিন্তাটিকে নিজস্ব পদ্ধতিতে ব্যবহার করে যৌনতৃপ্তি পেয়ে থাকে। যেমন- কেউ কেউ ব্যথা দিয়ে বা ব্যথা পেয়ে যৌন অনুভূতি লাভ করে। নিজে ব্যথা পেয়ে বা পাওয়ার অনুভূতি নিয়ে যৌনানুভূতিকে বলে ‘মেসোকিজম’ এবং অন্য কাউকে ব্যাথা দিয়ে যৌনানুভূতি পাওয়াকে বলে ‘সেডিজম’। দুটোই প্যারাফিলিয়া। হাজারো রকম প্যারাফিলিয়া আছে যেমন পশুর সাথে যৌনকর্মকে বলে জু-ফিলিয়া, ছবি দেখে যৌনসুখ পাবার বিষয়টিকে বলে পিকটোফিলিয়া; শিশু বা ছোটদের সাথে যৌনসুখ পাবার বিষয়টিকে বলে মাইক্রোফিলিয়া; পচা, দুগ্ধযুক্ত দ্রব্যাদি দেখে যৌনসুখ পাবার বিষয়টিকে বলে মাইজোফিলিয়া ইত্যাদি।
 
কেন প্যারাফিলিয়া হয় সেটি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। গবেষণায় অনেক কারণ বেরিয়ে এসেছে তবে কোনটিই এককভাবে নির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। একইভাবে হোমোসেক্সুয়ালিটির বিষয়টি নিয়েও গবেষণা চলছে এবং সেখানেও যে কারণগুলি জানা গেছে তা নিয়েও এখন পর্যন্ত  বিতর্ক ও ভিন্নমত আছে।  হোমোসেক্সুয়ালিটির বিষয়টি কি জন্মগত নাকি পরিবেশগত চর্চা থেকে- সেটিরও এখনও সুরাহা হয়নি। দুপক্ষেরই শক্ত অবস্থান আছে, যদিও গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলি মূলত জন্মগত বা জেনেটিক বিষয়ের চেয়ে পরিবেশগত চর্চাকেই বেশি প্রতিষ্ঠা করেছে।
 
প্রথম থেকেই হোমোসেক্সুয়ালিটি ও প্যারাফিলিয়া দুটি বিষয়কেই অস্বাভাবিক জ্ঞান করে প্রতি ক্ষেত্রেই চিকিৎসা নেবার তাগিদ দেওয়া হয়ে আসছিল। চিকিৎসা বলতে শুধু ঔষধপত্র নয়, এই ওরিয়েন্টেশন থেকে পরিত্রাণের যাবতীয় ব্যবস্থাদি। বিগত বছরগুলিতে কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংগঠন হোমোসেক্সুয়ালিটির বিষয়টিকে আর অস্বাভাবিক বলে মেনে নিতে চাইছে না। তাদের মতে এটি স্বাভাবিক যৌন আচরণ সুতরাং তাদের যৌন অধিকার দিতে হবে। তাদের মতে এরা সেক্সুয়াল মাইনোরিটি। সুতরাং এরা যৌন অধিকার বঞ্চিত ফলে তাদেরকে তাদের যৌন অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে।  
 
সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন এবং বায়োলজি চিকিৎসার ফলে পরিবর্তন হয় এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে স্বাভাবিক আচরণে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। পরিণত বয়সে যাওয়ার আগে যাদের চিকিৎসা শুরু করা হয় তাদের ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিমাণ বেশি হয়। খুবই প্রচারিত চরিত্র ভারতের অমলার ঘটনাটি এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
 
অমলা ছিল একজন ভারতীয় অধিবাসী । তার বায়োলজিক্যাল গঠন ছিল ত্রুটিপূর্ণ যাকে প্রচলিত অর্থে ‘হিজড়া’ বলে এবং সে অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন। যদিও সমাজিকভাবে এ পুরো বিষয়টি অপ্রকাশিত ছিল। সমাজে সে নারী হিসেবেই বেড়ে উঠিছিল।  সে ছিল অপূর্ব সুন্দরী, স্বাভাবিকভাবে তার এ ক্রুটির বিষয়টি কেউ বুঝতে পারত না ফলে অমলা  স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করত। একদিন সে গ্রামের একটি বিয়েতে যায়, সেখানে কার্তিক নামে এক যুবক তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ে এবং বিয়ে করতে চায়। কিন্তু অমলা তার সমস্যার জন্য কিছুতেই বিয়েতে রাজি হয় না। কার্তিকও ছিল এ ক্ষেত্রে নাছোড়বান্দা, সেও  পিছু হটবার পাত্র নয়। শেষ পর্যন্ত আর কোন উপায় না দেখে অমলা তার সমস্যার বিষয়টি কার্তিককে জানায়। কার্তিক সব জানার পরও অমলাকে বিয়ের ব্যাপারে পিছু হটে না।
 
এরপর অমলার পরিবারের সহযোগিতায় তাদের দুজনের বিয়ে হয় কিন্তু কার্তিক সমাজ ও তার পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়। তাদের বিয়ের বেশকিছুদিন গেলে কার্তিক একদিন পত্রিকা দেখে জানতে পারে অমলারমত এরকম ক্রুটি নিয়ে জন্মানো একটি শিশু চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়েছে। সে অমলাকেও সেখানে নিযে যেতে আগ্রহী হয়। অমলা যেতে না চাইলও কার্তিকের জোরাজুরিতে সে রাজি হয়। ডাক্তার অমলাকে দেখে জানায় এই বয়সে এটা চিকিৎসার মাধ্যমে সফল হওয়া প্রায়  অসম্ভব। কিন্তু কার্তিক এর আগ্রহ এবং আবেগের কাছে হার মেনে ডাক্তার তার সমস্যাটিকে আমলে নেন। সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার অমলাকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন এবং অপারেশন করেন। অপারেশনের পর অমলা সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং একজন সম্পূর্ণ নারীতে পরিণত হন।  পরবর্তীতে তিনি সন্তানেরও জন্ম দেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের অভিমত হচ্ছে- অমলার ব্যাপারটি তিনি মূলত কার্তিকের অনুরোধেই দেখেন এবং দেখার পরই তিনি খেয়াল করেন,  অমলার ত্রুটিটি সংশোধনযোগ্য, তার মধ্য নারী বৈশিষ্ট্য প্রকট ভাবে বিদ্যমান। তিনি একারণে  অস্ত্রোপচার করেন। তবে কার্তিক মনে করেন তার ভালবাসার জন্যই সৃষ্টিকর্তা তাকে পুরস্কৃত করেছেন।

দেশ, কাল, জাতি, সামাজিক অবস্থান, পরিবেশ, চর্চা ইত্যাদি ভেদে সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন, প্রিফারেন্স এবং অধিকারের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্র কি ধরনের যৌন অধিকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দান করবে সেটি যে শুধু শুভ যুক্তির উপরে নির্ভর করে তা নয়, এটির সাথে ভোটের রাজনীতি এবং  মানুষের ভাবাবেগ ইত্যাদি অনেক বিষয়ও  জড়িত- যার সবগুলির সাথে যুক্তি যায় না।

ক্রমশ....
 

এই সিরিজ এর সব লেখা
ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 30/06/2015
সর্বমোট 9492 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ