ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

সমকামিতা (পর্ব-নয়): সোসাল অরিয়েন্টেশন

কোন প্রাণি যে সমাজে বেড়ে ওঠে প্রতিনিয়ত চর্চার মাধ্যমে সে সেই সমাজের নানা বিষয় সম্পর্কে এমনভাবে অবহিত হয় যে এক সময়ে তার ব্রেন সে বিষয়গুলিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একটা বাঘ ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য শিকার করে খাবার কথা ভাবে, একটা বক মাছ শিকার করে খাবার কথা ভাবে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের একটা পোষা কুকুর ভাঙ্গা মালসায় ফ্যান খাবার কথা ভাবে, ইউরোপের একটি পোষা কুকুর পরিচ্ছন্ন পাত্রে খাবার কথা ভাবে। পোশাক-আশাক, চলন-বলন সবকিছুতেই এই চর্চা পরিলক্ষিত। বৃহৎ অর্থে এটা সংস্কৃতি। সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির ধারাও পরিবর্তিত হয় তবে তারও একটা গতি আছে, একটা নিয়ম আছে। মূলত সমাজের বৃহৎ অংশের চাওয়া ও চর্চাগত বিষয়ের পরিবর্তনের সাথে এ পরিবর্তন সম্পর্কিত। এছাড়াও আছে পরিবেশ, প্রতিবেশগত পরিবর্তন- যা আসলে মানুষের চাহিদাগত প্রয়োজনকে প্রভাবিত করে।
 
সমাজে বসবাস করে একটা প্রাণি যা কিছু করে সেটি তার সামাজিক অরিয়েন্টেশন এর রেসপন্স। সামাজিক অরিয়েন্টেশনও সমাজ পরিবর্তনের সাথে বদলাতে থাকে। অনেক সময়ে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের বিষয়টি আমলে রেখে সমাজের কিছু কিছু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করা হয়। যেমন- শৌচকর্ম শেষ করে সঠিক উপায়ে হাত ধোয়া বা হাত ধুয়ে ভাত খাওয়া এবং খাওয়ার পরে আবার হাত ধোওয়া, যত্র-তত্র মল-মূত্র ত্যাগ না করে নির্দিষ্ট স্থানে ত্যাগ করা যাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি না থাকে, পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করা, নিরাপদ যৌন মিলনের জন্য নির্দিষ্ট ও বিশ্বস্ত যৌনসাথীর সাথে স্বাভাবিক যৌন মিলন করা এবং এর ব্যতিক্রম হলে ব্যারিয়ার পদ্ধতি বা কনডম ব্যবহার করে যৌন মিলন করা ইত্যাদি। মানুষের স্বাভাবিক অভ্যাসগত পরিবর্তনের ধারাকে এরকম নানা প্রয়োজনে প্রভাবিত করা হয়েছে। এর কারণ, এগুলি বৃহৎ সমাজের জন্য প্রয়োজন। সমাজের সবাই যদি এ কাজগুলিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তবে সমাজের কোন ক্ষতি হবে না বরং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধিত হবে।
 
আমরা বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, প্লেনে যাতায়াত করি। আমাদের পাশে বসা লোকটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের পরিচিত থাকে না, জীবনে তার সাথে আর কোনও দিন দেখা হবে সে সম্ভাবনাও থাকে না, ইচ্ছে করলেই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যায় কিন্তু আমরা তা করি না। এই যে না করার বিষয়টি- এটা হচ্ছে সামাজিক অরিয়েন্টেশন। সমাজ আমাদেরকে শেখাতে চেষ্টা করেছে, অন্যের সাথে মানবিক ব্যবহার করতে হয়। সবাই যদি অন্যের সাথে মানবিক ব্যবহার করে তবে তাতে সমাজের ক্ষতি হবার কোন সম্ভাবনা নেই বরং সর্ব অর্থেই উপকার। 
 
অধিকার হিসেবে কোন কিছুকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এই বৃহৎ সমাজের প্রয়োজন ও চর্চার বিষয়টি আমলে রাখা দরকার। যৌন আকর্ষণ ও যৌন চর্চার বিষয়টিতেও সামাজিক অরিয়েন্টেশনের প্রভাব আছে। ফলে যে চর্চাটি সর্বসমাজের জন্য সুফলদায়ক সেটিকে প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেওয়াই ভাল। যদি সমাজের সবাই হেটারোসেক্সুয়াল হয় এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে যৌন কর্ম করে তবে তাতে সমাজের ক্ষতি নেই কিন্তু সবাই যদি সমকামী হয়ে যায় সেক্ষেত্রে সমাজ টিকবে না। যদিও সমকামীরা দেশ, সমাজ নিয়ে খুব একটা ভাবে না। সেক্সের প্রাথমিক আনন্দ যৌনতৃপ্তি, শিশু জন্ম দেওয়াটা সেকেন্ডারি- সমকামীরা প্রাথমিক বিষয় নিয়েই তৃপ্ত, তাদের জন্মের সর্ব সার্থকতা সমকামের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে সমকামকে  অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ‘যৌন-মানুষ’ তৈরির বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবী রাখে বৈকি।
 
বিশ্বের যে ১১৩টি দেশে সমকামকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে সে দেশগুলির প্রেক্ষাপট আমাদের দেশ থেকে ভিন্ন। শুধু ভিন্নতার কারণেই নয়, এর অন্য দিকও আছে। এই মানসিকতার মানুষ বেড়ে যাওয়ায় সে সব দেশও সঙ্কটের নতুন দিকগুলি নিয়ে ভাবছে। এই মানসিকতার মানুষগুলি তাদের মোট সময়ের একটা বিশাল অংশ শুধু কামচিন্তায় ব্যয় করে। কামচিন্তা এদের ধ্যান-জ্ঞান, অন্য কোন কিছু নিয়ে এদের কোন মাথাব্যথা নেই। দেশ, সমাজ, সংসার কোন কিছুই এদের স্পর্শ করে না। অন্যের প্রতি দায়বোধ এদের নাই। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের শপিং মলে বাজার করতে গিয়ে দেখেছি সমকামীরা দুজন সবসময়ে ল্যাপ্টালেপ্টি করে হাঁটাচলা করে। দৃষ্টিকটু এবং ব্রিতকর সে চলাফেরা। আলাদাভাবে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে এদের কখনও দেখিনি। সেটা হয়ত আমারই বারংবারের দুর্ভাগ্য।

ফুলেরমত চমৎকার শিশুরা দৌড়োদৌড়ি-ছুটোছুটি করে খেলা করে সেদিকে এরা তাকায়ও না। তাকাবে কেন! যৌন সম্পর্কের দ্বারা সন্তান জন্মদানের এ বিষয়টিই ওদের মাথায় অনুপস্থিত। যৌনকর্ম করে বাচ্চা নেওয়া, তাকে লালন-পালন করে গড়ে তোলা ওদের কাছে সময় নষ্ট। ওরা মনে করে সমাজের সব মানুষ পাগল- যৌন কর্ম বাদ দিয়ে বাচ্চা জন্ম দিয়ে তাদের পিছনে সময় দিয়ে এ বৃহৎ সমাজ বিশাল বড় বোকামির পরিচয় দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ওরা জিতে আছে কারণ ওরা সারাক্ষণ যৌনতা নিয়ে থাকতে পারছে, অন্যরা তা পারছে না। চিন্তা-চেতনায় এরা ভয়াবহরকম আত্মকেন্দ্রীক। তারা সমগ্র সমাজের উপরে ক্ষুব্ধ, কেন সমাজ তাদের এ বিষয়টিকে মেনে নিচ্ছে না- এ জন্য তারা সমগ্র সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখে। একজন হেটারোসেক্সুয়াল মানুষকে তারা শত্রুর চোখে দেখে কারণ, এর এই স্বাভাবিক চর্চার জন্যেই আজ ওর চর্চাটা অস্বাভাবিক বলে গণ্য হচ্ছে।
 
 
একটা কথা পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার যে, কখনও-সখনও সমকাম করা আর সমকামিতার প্রতিষ্ঠা এক জিনিস নয়, আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  সমকামিতার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি এবং প্রাসঙ্গিকভাবে সমকামের বিষয়টি এখানে এসে যাচ্ছে এবং আগামীতে আরও আসবে। যৌন তৃপ্তির জন্যেই হোক আর অন্য যে কোন কারণেই হোক সমলিঙ্গের সাথে যৌনমিলন করে যৌনসুখ পাওয়া আর এ ধরণের যৌন সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করার মধ্যে পার্থক্য আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়; একজন সমকামী আসলে একজন উভকামী। জেলখানায়, এতিম খানায়, বন্দীশালায় বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীর অভাবে যৌনসুখ পাবার জন্য সমকাম করা মানে যে তারা সমকামিতা প্রতিষ্ঠার সমর্থক তা নাও হতে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয়ও না। হেটারোসেক্সুয়াল যৌনতৃপ্তি পাবার সুযোগের অভাবে সমকাম করা, বা বাই-সেক্সুয়াল হয়ে সমলিঙ্গ পেলে সমলিঙ্গ, বিপরীতলিঙ্গ পেলে বিপরীত লিঙ্গের সাথে যৌনকর্ম করা আর সমকামিতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এক জিনিস নয়। নিখাদ সমকামী হচ্ছেন তারা যারা সকল সুযোগ থাকার পরেও হেটারোসেক্সুয়াল হতে রাজি নন তারা। সুযোগ-সুবিধা থাকার পরেও যখন যেটা পেলাম তখন সেটা করলাম- এটা সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স; যেটাকে সহজভাবে বলা হয় চরিত্রহীনতা। এটা সেক্সুয়াল কমিটমেন্টের অভাব, ওরিয়েস্টেশনের ঘাটতি তো আছেই তবে সমকামিতা নয়।
 
যে অর্থে আমি সমকামিতার বিষয়টিকে দেখছি তা এরকম- স্বামী বা পুরুষ যৌনসঙ্গীর অভাবে এবং সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রভাব থেকে নিজেকে দায়মুক্ত রেখে একজন নারীর সঙ্গোপনে সমকাম করা মানে তা সমকামিতা নয়। বৈরি পরিবেশের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ পেলে সে আবার স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ককে গ্রহণ করে নেবে। একইভাবে বিষয়টি কোন পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। সুতরাং সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন ঠিক থাকার পরেও সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স এর সুযোগ এখানে নাই ফলে সমকামী যৌন চর্চার জন্য পরিবেশ-প্রতিবেশ এখানে দায়ী। সবকিছু ঠিক থাকার পরেও যাদের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন ও সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স সমকামের দিকে সেটিই হচ্ছে মূলত সমকামিতা। ক্ষুধার জ্বালা নিবৃত্তির জন্য খাদ্য চুরি করে খাওয়া আর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য চুরিকে বৈধ করে দেওয়া এক কথা নয়। মানুষ যাতে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য খাদ্য পায় সেটি একটি দাবী হতে পারে বা তা করার জন্য সম্ভাব্য কি কি করা যেতে পারে দাবী নামায় তা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিন্তু চুরিকে বৈধ করার দাবী উঠতে পারে না। উঠলেও তাকে সঙ্গত বলার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।

জেলখানা, এতিম খানা, বন্দীশালা ইত্যাদি যায়গায় যেখানে বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীর অভাবে যৌনসুখ পাবার জন্য সমকাম করা হচ্ছে সেরকম যায়গা থেকে সমকামিতা প্রতিষ্ঠার দাবী ওঠেনি। সমকামিতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের কাছ থেকেই উঠে এসেছে এবং পপুলার হয়েছে যারা কোনভাবেই যৌনবঞ্চিত নয়। সকল সুযোগ থাকার পরেও যারা সমকামিতার চর্চাকে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী এ দাবী তাদের; তারাই পরবর্তীতে এ সকল বঞ্চিতদের বিষয়টিকে নিজেদের দাবী আদায়ের জন্য যুক্তি হিসেবে দাঁড়া করিয়েছে, তাদেরকে এ দলে ভিড়িয়েছে। সমকামিতা প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন সেটি হতে পারত সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন ও সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স সঠিক করার আন্দোলন, সেক্সুয়াল পার্টনার পাবার আন্দোলন- কিন্তু তা হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- জেলখানায় যিনি সাজাপ্রাপ্ত আছেন তিনি যদি বিবাহিত হন তবে তারপক্ষে গিয়ে আন্দোলনকারীরা বলতে পারত কয়েদির স্বামী বা স্ত্রীকে সপ্তাহে বা দু সপ্তাহে একবার তার সাথে যৌনকর্ম করার অধিকার দিতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্ক অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ক্ষেত্রেও উঠতে পারত এমন কোন দাবী। অথবা কোন ব্যক্তির অপরাধ জনিত শাস্তির থেকে তার যৌনতার বিষয়টিকে আলাদা করে দেখতে হবে- এ জতীয় কিছু। এমন কোন কিছু না হয়ে সরাসরি সমকামিতা প্রতিষ্ঠার দাবী ওঠা এবং তা প্রতিষ্ঠা লাভ করার পেছনের কারণ ভিন্ন। এটা বাণিজ্যিক- কোন না কোন গোষ্ঠীর এতে স্বার্থ সংরক্ষিত হয়, যেখানে সমকামীদের স্বার্থ নিতান্তই গৌণ।

ক্রমশ...

এই সিরিজ এর সব লেখা
ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 06/07/2015
সর্বমোট 5841 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ