ব্যাকগ্রাউন্ড

ফেইসবুকে!

সমকামিতা (পর্ব-তিন): বৃহন্নলা (উপপর্ব- দুই)

২০০৬ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল এইডস কমিটি একটি জরিপ করে যেখানে দেশে মোট হিজড়া বা বৃহন্নলার সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়। ঐ জরিপে এমএসএম বা মেল সেক্স উইথ মেল বা পুরুষ সমকামীর সংখ্যা দেখান হয়েছে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার। জরিপ মানে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বা কাছাকাছি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যের কোন সংখ্যা হওয়াই যুক্তিপূর্ণ ও প্রত্যাশিত। এ সংখ্যা সেক্টর ভিত্তিক ন্যাশনাল রিসোর্স এ্যালোকেশন ও পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যায় বড় ধরনের ফারাক একদিকে জরিপকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করে, অন্যদিকে ন্যাশনাল রিসোর্স এ্যালোকেশন বা জাতীয় সম্পদ নির্ধারণে সমতা আনতে ব্যর্থ হয় যা সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নেরও অন্তরায়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল এইডস কমিটির জরিপের ফলাফলের দিকে তাকালে এমন ফারাকের বিষয়টি চোখে পড়ে এবং জরিপের শুদ্ধতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। সেটি হয়তবা যিনি বা যারা দেখছেন তাদের দেখার বা বিশ্লেষণের ত্রুটি, তবে যদি কেউ এভাবে দেখেই থাকেন তবে তাকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল এইডস কমিটির জরিপে বৃহন্নলার সংখ্যা বলা হয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার; এখানে নিম্নতম সীমা ১০ হাজার এবং ও ঊর্ধ্বতম সীমা ১৫ হাজার, দুইয়ের মাঝে পার্থক্য বা ভেরিয়েশন রয়েছে ৫০ ভাগ যা ভিত্তিগতভাবে খুব দুর্বল বলে আমার কাছে প্রতীয়মান। অন্যদিকে এমএসএম এর সংখ্যা বলা হয়েছে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার। এখানেও ভেরিয়েশন প্রায় ৪০০ ভাগ। এটির ভিত্তিগত বিষয়টি আমার কাছে আরও বেশি দুর্বল মনে হয়েছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল এইডস কমিটির জরিপের পরে সম্ভবত ২০১১ সালে আইসিডিডিআরবি আরেকটি জরিপ করে যেখানে মোট হিজড়ার সংখ্যা বলা হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ জন এবং এমএসএম বা মেল সেক্স উইথ মেল বা পুরুষ সমকামীর সংখ্যা বলা হয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার। এ জরিপের ফলাফলকে আমলে নিলে তা ভিত্তিগতভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়।

১১ নভেম্বর ২০১৩ সালে বিডিনিউজে ‘‘স্বীকৃতি পেল তৃতীয় লিঙ্গ’’ শিরোনামে প্রকাশিত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রেফারেন্স দিয়ে হিজড়াদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে-

‘‘ক্রোমোজোম বা হরমোনে ত্রুটি অথবা মানসিক কারণে কারও লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে জটিলতা দেখা দিলে বা দৈহিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে আচরণগত মিল না থাকলে তাদের চিহ্নিত করা হয় হিজড়া হিসেবে।’’

যদিও শারীরিক ত্রুটি সংক্রান্ত অসঙ্গতির বিষয়টি হিজড়াদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তারপরেও আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে প্রতীয়মান হয়। বৃহন্নলা বা শিখণ্ডীদেরকে সাধারণভাবে চিহ্নিত করা হয় ‘হার্মফ্রোডাইট’ হিসেবে। হার্মফ্রোডাইট এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে এখানে ‘উভলিঙ্গ’ বোঝান হয়েছে। উভলিঙ্গত্বকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়– প্রকৃত উভলিঙ্গত্ব বা ট্রু হার্মফ্রোডাইট এবং অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব বা সিডো হার্মফ্রোডাইট। প্রকৃত উভলিঙ্গ হচ্ছে একই শরীরে স্ত্রী এবং পুরুষ দু ধরণের যৌনাঙ্গেরই সহাবস্থান থাকা এবং অপ্রকৃত উভলিঙ্গ হচ্ছে সেটি না থেকে যে কোন একটি অকার্যকর অবস্থায় থাকা। মানব সমাজের বাইরে প্রকৃতিতে প্রকৃত উভলিঙ্গত্বের সংখ্যা খুবই কম, বেশি দেখা যায় অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব।

প্রধানত দুটি কারণে উভলিঙ্গত্ব দেখা দেয়- একটি হরমোনগত কারণ যেখানে মূলত এন্ড্রোজেন নামক হরমোনটি বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং অন্যটি জেনেটিক কারণে হয়, যেখানে XY অস্বাভাবিক ভূমিকা রাখে। সাধারণত ছয় ধরনের অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব দেখা যায়-

১. কনজেনিটাল এড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া
২. এন্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম
৩. গোনাডাল ডিসজেনেসিস
৪. হাইপোস্পাডিয়াস
৫. টার্নার সিনড্রোম এবং
৬. ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম। উভলিঙ্গত্বের বিভিন্ন প্রপঞ্চের উদ্ভব বিভিন্ন কারণে হয়।

প্রচলিতভাবে উভলিঙ্গত্বকে অস্বাভাবিক মনে হলেও প্রকৃতিগতভাবে এটি অস্বাভাবিক নয়। প্রাণিজগতের গোঁড়ার দিকে যে সমস্ত পর্ব বিরাজমান ছিল সে সমস্ত প্রাণিদের বেশিরভাগই ছিল উভলিঙ্গ বা হার্মাফ্রোডাইট। যেমন– প্রটোজোয়া, পরিফেরা, সিলেনটেরেটা, প্লাটিহেলমিনথিস, অ্যানিলিডা, মোলাস্কা ও কর্ডাটা। এদের শরীরে স্ত্রী ও পুরুষ জননাঙ্গের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এদের জন্য উভলিঙ্গত্ব কোনও শারীরিক ত্রুটি নয়, বরং এটি পুরোপুরি ‘প্রাকৃতিক’। প্রকৃতিতে এখনও পালমোনেট, স্নেইল এবং স্লাগেদের অধিকাংশই ‘হার্মাফ্রোডাইট’ বা উভলিঙ্গ।

সমকালীন সময়ে নৃশংশভাবে খুন হওয়া বিশিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ক সৃশনশীল এবং বিশ্লেষণী লেখক শ্রদ্ধাভাজন ব্লগার অভিজিৎ রায় তার একটি লেখায় বলেছেন, “হিজড়া বলে কথিত এই প্রান্তিক মানুষদের একটা বড় অংশই হচ্ছে রূপান্তরকামী । আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং সমীক্ষায় আমি দেখেছি, এদের অধিকাংশই উভলিঙ্গত্ব থেকে নয়, বরং জেন্ডার-সংশয় (gender dysphoria) থেকে কিংবা নানা সামাজিক চাপ থেকে উভলিঙ্গ মানব বা ‘হিজড়া’ হয়েছেন। এদের মনোভাব অনেকটা এ রকমের– আমি ছেলে, অথচ আমি মেয়েদের প্রতি আকর্ষণবোধ না করে ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হই। তাহলে নিশ্চয়ই আমি মেয়ে। কিন্তু আমার শারীরিক গঠন তো ছেলের মতো, তাহলে বোধহয় আমি হিজড়া। এই মনোভাব থেকে অনেকে হিজড়া-পল্লীতে আশ্রয়গ্রহণ করলেও দেখা গেছে এরা আসলে মূলত সমকামী কিংবা রূপান্তরকামী।’’

ক্রমশ….

এই সিরিজ এর সব লেখা
ছবি
সেকশনঃ সাধারণ পোস্ট
লিখেছেনঃ যুক্তিযুক্ত তারিখঃ 23/05/2015
সর্বমোট 7431 বার পঠিত
ফেসবুকের মাধ্যমে কমেন্ট করুণ

সার্চ